ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছে পা, উদয়ের জীবন চলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছে পা, উদয়ের জীবন চলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে ক্র্যাচে দুই হাত ভর দিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে দশ বছরের উদয় কুমার দাস। তার ডান পা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় প্রায় এক বছর আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। ছোট শিশুটি বেড়ে উঠছে ক্র্যাচে ভর দিয়ে। ক্যান্সার ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে উদয়ের সঙ্গে আছে তার বাবা-মা। ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে সিএনজিতে উঠবে বলে। গন্তব্য গ্রামের বাড়ি ভৈরবে। প্রতি ২১ দিন অন্তর উদয়কে নিয়ে তার মা এ ক্যান্সার হাসপাতালে আসেন কেমোথেরাপি দেয়ার জন্য। হাসপাতালে এলেই ভর্তি থাকতে হয় কখনও দশ দিন আবার কখনও পনেরো দিন। উদয়ের মা বললেন, ‘এবার ভাগ্য ভালা, তাই দশ দিনেই পোলা সুস্থ হইছে। আজকাই বাড়ি যাইতাছি।’ প্রতি মাসের ১৫ দিনই মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকতে হয় উদয়কে। কারণ, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিতে দীর্ঘ সিরিয়ালে পড়তে হয় তাদের। অনেক সময় সিরিয়াল দেয়া থাকলেও নির্দিষ্ট দিনে কেমো দেয়ার সিডিউল পান না এসব সাধারণ রোগী। তাই বাধ্য হয়েই এক সপ্তাহ কিংবা দশ দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। এরপর কেমোথেরাপি অথবা রেডিওথেরাপি দেয়ার পর দু’-একদিন রেখে ছেড়ে দেয়া হয় রোগীদের। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে যেসব রোগী চিকিৎসা নিতে এ হাসপাতালে আসেন তাদের বেশিরভাগই ভর্তি থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। উদয়ের মা বললেন, ‘সময়মতো পোলারে কেমো দিতে পারি না। কথা থাহে একদিন, দেয় অন্যদিন। পোলার শরীরে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। এর লাগি ভর্তি থাকন লাগে। কাইলকা কেমো দিছে এহন পোলা ভাল, তাই নিয়া যাইতাছি। আবারও তো ২১ দিন পর আওন লাগব।’ তবে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে আলাদা কোন খরচ গুনতে হয় না বলে সন্তোষ প্রকাশ করলেন উদয়ের বাবা। তিনি বললেন, ‘এলাকায় একটা ফার্নিচারের দোহানে আমি বার্নিশ করি। বাড়িত আরও দুইটা পোলা-মাইয়া আছে। তাগও স্কুলে পড়াই। উদয়ের পিছে তো এই এক বছরে তুই লাখ ট্যাকার মতো খরচ হইছে। এহন ত্বরিত পোলার এগারোডা কেমো দেওন লাগছে আর দুইডা রেডিও। কেমোতে পাঁচ হাজার আর রেডিওতে দশ হাজার খরচ হয়।’ অন্য আর পাঁচটি স্বাভাবিক শিশুর মতো দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ও হাঁটতে না পারলেও এক পায়ে ভর করে নিয়মিত স্কুলে যেতে অভ্যস্ত উদয়। সে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। পড়ালেখা করতে তার খুব ভাল লাগে বলে হাসল উদয়। সে বলল, ‘ডান পায়ে আর হাতে হকল সময় ব্যথা করে। যহন শরীর ভালা লাগে তহন পড়ি। স্কুলেও যাই।’ ছোট শিশু উদয় হয়ত এখনও বুঝছে না সে এক মরণব্যাধির সঙ্গে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। এত অল্প বয়সে কিভাবে উদয় এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলো- জানতে চাইলে তার মা বললেন, ‘পোলার ডান পায়ের হাঁটুর হাড়ে একটা টিউমার হইছিল। অপারেশনও করাইছিলাম। ক্যামনে কী হইয়া গেল! পোলা ভাল হওনের বদলে খারাপ হইয়া গেল। ক্যান্সার বাড়নের সাথেই এই পা অপারেশন করে কাইটে ফেলা হইছে। তাও আমার পোলা এহনও সুস্থ হয় নাই। ক্যান্সার কি আর আমার পোলারে ছাড়ব না? ২১ দিন পর পর আওন-যাওনে বেশি কষ্ট হয়। যদি ভৈরবে একখান ক্যান্সার হাসপাতাল থাকত তাইলে তো আর আমাগো এইহানে ট্যাকা খরচ করে আওন লাগত না।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ- অনুযায়ী ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ১৬০ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রয়োজন। দেশে সরকারী ও বেসরকারীভাবে মোট ১৪টি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হলেও এর মধ্যে ক্যান্সার হাসপাতাল ছাড়া অন্যগুলোতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। দেশে ক্যান্সার রোগী বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ছে না চিকিৎসাসেবা। নয়টি সরকারী হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এছাড়া বেসরকারী ছয়টি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ আকাশছোঁয়া। তাই মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট সাধারণ ক্যান্সার রোগীদের জন্য শেষ ভরসা। কিন্তু এ হাসপাতালে আসন সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এজন্য বিভাগীয় এলাকাগুলোতে ক্যান্সার হাসপাতাল থাকা জরুরী বলে মনে করছেন চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্যান্সার রোগীদের শেষ ভরসার জায়গা জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট। ক্যান্সার রোগীর তুলনায় সরকারী হাসপাতালের সংখ্যা কম। এত রোগীকে সামলাতে আমরাও হিমশিম খাই। ক্যান্সার যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন চিকিৎসা করে একদম সুস্থ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। যদি বিভাগীয় পর্যায়ে ক্যান্সার হাসপাতাল থাকে, তখন রোগীদের চিকিৎসাসেবা নাগালের মধ্যে আসবে। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সবকিছু মিলে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের দিনটিতে উদয় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছে। তবে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে না। কারণ মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে বেশিরভাগ রোগীকেই এর সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হয়। বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও এ রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে, ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারের কাছে হেরে যাচ্ছেন প্রতি বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মরণব্যাধি ক্যান্সারে প্রতি বছর দেশে আক্রান্ত হচ্ছেন ১৫ লাখ মানুষ। এছাড়া এ রোগের থাবায় মৃত্যুবরণ করছেন ৯১ হাজার মানুষ। অন্যদিকে দেশে প্রতিদিন নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন ৩৩৪ জন, মারা যাচ্ছেন প্রায় ২৫০ রোগী। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর সর্বস্বান্ত হচ্ছেন দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তা ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তবে একমাত্র সচেতনতাই পারে ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে। ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধে জোর দেয়া দরকার প্রাথমিক প্রতিরোধের ওপর। ক্যান্সার যাতে না হয়, তার জন্যই প্রাথমিক প্রতিরোধ। এজন্য প্রয়োজন ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়িয়ে চলা ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
×