ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মমিন সরকার

কাণ্ডারি হুঁশিয়ার!

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কাণ্ডারি হুঁশিয়ার!

নৌকা বাঙালীর জীবন যাত্রার সঙ্গে স্থান ভেদে কমবেশি সার্বক্ষণিকভাবে জড়িত। বলা চলে জীবনাচারের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ নৌকা। এটাই আবার প্রতীক হয়েছে শত সংগ্রামের, আন্দোলনের, স্বাধিকার থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার। বস্তুগতভাবে নৌকা ভেসে থাকার মতো জলযান। এর নির্মাণ আকৃতি ক্ষুদ্র-বিশাল যা-ই হোক বস্তুগত বা পদার্থ গুণের কারণে তা ভেসে থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। লোহা-কাঠের নৌকা প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝায়, আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় দক্ষ মাঝিবিহীন সঠিক পরিচালনার অভাবে নৌকাডুবি যেমন অস্বাভাবিক নয়, তেমনি প্রতীকের নৌকা কা-ারির সঠিক ও দক্ষ পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটলে তা আর শুধু ডুবেই যায় না, তা হয় ভরাডুবি। পণ্যবাহী নৌকাডুবিতে মালামালের বা আর্থিক ক্ষতি হয় কখনও সাময়িক। কিন্তু আদর্শের ভরাডুবিতে ক্ষতি হয় জাতিগত ও সুদূরপ্রসারী। আমাদের বাঙালীর জাতীয় জীবনে শক্তহাতে হাল ধরে অশান্ত সময়ের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জাতির আকাক্সক্ষার পসরাভর্তি নৌকা তীরে পৌঁছে দিয়েছেন দক্ষ হাতের কা-ারিরা। ১৯৫৪ সালে এ নৌকার হাল ধরেছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সে দিনের তরুণ তেজোদ্বীপ্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সে-ই ১৯৫৪ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬৩ বছরের দুর্গম পথ পরিক্রমায় নৌকার জয় জয়কার ঘটেছে বার বার এ বাংলায়। নির্বাচন এলেই শহুরে সুবিধাভোগীদের কোলাহল ছেড়ে দূর গ্রামের ঝিল্লিমুখর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ছেলে-বুড়ো সবার মুখে যে প্রতীকের আওয়াজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠত, তা চিরায়ত বাংলার নৌকা। এমন প্রাণবন্ত ধ্বনি অন্য আর কোন মার্কায় উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। ১৯৭০’র সাধারণ নির্বাচনে আমরা গত শতাব্দীর মধ্যভাগে জন্ম গ্রহণকারী প্রজন্ম প্রথম ভোট দেই। ১২০০ মাইলের ব্যবধানে দুই পাকিস্তানে ভোটের লড়াই। এক রাষ্ট্র হলেও আশ্চর্যজনক সত্যি ছিল দেশের এক অংশের নির্বাচনের প্রতীকের প্রভাব অন্য অংশে পড়ে নেই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তথা পাকিস্তানের (বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনও পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করতেন না- তাঁর ভাষায় বাংলা, বড়জোর পূর্ব বাংলা, ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছিলেন ‘এই বাংলায়’...) পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ (শতকরা ৫৬ ভাগ) মানুষের কাছে নির্বাচনী প্রতীকের পরিচিতি ছিল নৌকা। পাকিস্তানভিত্তিক মুসলিম লীগের মার্কা ছিল বাঘ, আর ধর্মভিত্তিক কয়েকটি খুচরা/আঞ্চলিক দলের মার্কা ছিল বই, তালগাছ, খেজুর গাছ, বট গাছ, হুক্কা- এমন কিছু। তবে বাংলাদেশে বিশেষত কুমিল্লায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের প্রাদেশিক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের ‘কুঁড়েঘর’ মার্কাটি চান্দিনা-দেবিদ্বার নির্বাচনী এলাকায় তুলনামূলক বেশি শোনা যেত। ব্যক্তি হিসেবে তিনি শ্রদ্ধাভাজন হলেও তাঁর কুঁড়েঘর মার্কা নৌকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত আওয়াজে তলিয়ে যেত। লোকে রসিকতা করে বলত, ‘ন্যাপ নেতা-মোজাফ্ফর, মার্কা তার কুঁড়েঘর, ভাইংগা চুইরা নৌকা-ত ভর’। ফলাফলও তাই হয়েছিল। ইসলামপন্থী আরেক মার্কা ছিল ‘গাভী’। স্থানীয়ভাবে উচ্চারিত হয় ‘গাই’। প্রায় অখ্যাত প্রার্থী মাওলানা আবদুর হাই (যার নাম এখন আর কেউ জানে না বা চিনেও না) রসিকতা করে তাঁর নামেও সেøাগান হতো ‘হক সাহেবের গাভীন গাই- ভোটের আগে বিয়ান চাই’। ১৯৭০’র সে নির্বাচনে নৌকার কাছে অন্য সব মার্কার জামানত বাজেয়াফত হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কুড়েঘর মার্কাওয়ালা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের দলীয় আদর্শগত সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকাকে পরাস্ত করতে রাশিয়াকে স্বপক্ষে কাজে লাগাতে তাঁর কূটনৈতিক সাফল্য ইতিহাস তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। অন্য দল এবং মার্কা বিলীন হয়ে গেছে। রাজনীতির ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং এক রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে ‘জয় বাংলা’র সারিগান গেয়ে এ নৌকার যাত্রীদের তথা সারা জাতিকে স্বাধীনতার বেলাভূমিতে পৌঁছে দিয়ে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫-এ জাতির পিতা শেখ মুজিবের মর্মান্তিক তিরোধানের পর দেশে জিয়া ও এরশাদের আমলে যে কয়টি তামাশার নির্বাচন হয়েছে তা বাদ দিয়ে নৌকার কা-ারি আওয়ামী লীগ যতবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তত বারই নৌকার জয়ধ্বনিতে বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে। নির্বাচনের মাঠে নৌকার জোশই আলাদা। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার হিসেবে আজও বজ্রকণ্ঠে নির্বাচনী প্রচারণায় ভেসে আসে নৌকা নৌকা নৌকা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা (বিষাদ সিন্ধুর এজিদি ভাষায় ‘নির্বংশ’) করার অপচেষ্টার পর বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা পিতার দুঃখিনী বাংলায় ফিরে এসে বাংলার গণমানুষের রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা অজেয় প্রতীক নৌকার কা-ারি হয়ে শক্তহাতে হাল ধরে নৌকাকে নিয়ে গেছেন তৃণমূলের মার্কা হিসেবে। নিন্দুকেরা যে যতই বলুক এটা যে কত বড় সময়োচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তা ভবিষ্যতই প্রমাণ করবে। সময়ের প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বোধহয় দ্বিতীয়টি আর নেই। কালের পরিক্রমায় তা আজ প্রমাণিত হয়েছে, এ বাংলা চির দুঃখিনী নয়, গরবিনী, বিজয়নী বাংলা নব্য মীর জাফরদের বেইমানীর কারণে সাময়িক হোঁচট খেলেও সমৃদ্ধির সোপানে, উন্নয়নের সোনালী বন্দরে তা ভিড়বেই। তা যখন দক্ষ কা-ারির হাতে পড়েছে। কারণ এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে উত্তাল সমুদ্রেও এ কা-ারির দেশপ্রেম আর অবিচল অভিযাত্রার লক্ষ্য বা ‘আদম সুরত’ স্থির এবং সঠিক গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে তৃণমূলের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়ে গেছে বেশ কিছু দিন আগে। এবারই প্রথমবারের মতো তৃণমূলের স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। তৃণমূলে নৌকার হাল যার হাতে যাবার কথা বা যার নৌকা প্রাপ্য ছিল তিনি কি তা পেয়েছেন? তা কি যোগ্য ব্যক্তির হাতে পৌঁছেছে? বিনা দ্বিধায় বলা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পৌঁছেনি। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলার একটি করে উপজেলার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শতকরা ৬০% জন অযোগ্য প্রার্থীর হাতে নৌকা পৌঁছে গেছে। অযোগ্যদের অনেকেই একমাত্র নৌকার জোরে পাস করে গেছেন। আবার যেখানে নৌকার নিজ দলেরই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন সেখানে নৌকাকে পাস করার জন্য জোর জবরদস্তি করতে হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে হয়ত দল ক্ষমতায় আছে বলে। আবার নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন একই দলের অন্যজন। একই দলের হওয়ার কারণে নতুন নামকরণ পরিচিতি পেয়েছে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে। নৌকা না পাওয়া অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীর মার্কা ছিল আনারস। নৌকাকে হারিয়ে আনারস পাস করার বাস্তব কারণ খতিয়ে দেখা যায় নৌকার প্রকৃত ভোটাররা নৌকা প্রাপ্ত মাঝিকে পছন্দ না করলেও নৌকার আদর্শের মাঝিকে পছন্দ করেছেন। তবুও আদর্শের বাইরে যাননি। একই সময়ে নৌকা সমর্থক ভোটার নৌকা মার্কাকেও নিজে ভোট দিতে পারেননি। নৌকার লোকেরা জেনে গেছেন এ ভোটাররা যেহেতু নৌকায় ভোট দেবেন তবে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে লাভ কি। নিজেরাই ভোট নিয়ে তাদেরকে কষ্টের হাত থেকে রেহাই দিয়েছেন! এটা অবশ্য শুধু নৌকার বেলায় এক তরফা নয়। অন্য মার্কারও যার যেখানে জোর আছে সেখানে একই দলের সমর্থকদের নিজে ভোট দানের কষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছেন। কুমিল্লা জেলার পাশাপাশি দুটি উপজেলার (দেবিদ্বার-চান্দিনা) ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দেখেছি। একটি ভাত টিপেই এক হাঁড়ি ভাতের যেমন খবর পাওয়া যায়- তেমনি এক দুটি দিয়ে দেশের অন্য আর দশটির অবস্থা বুঝা কঠিন নয়। চান্দিনার তিনটি ইউনিয়নে (মাইজখার, মাধাইয়া ও মহিচাইল) নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আনারস। দ্বিমুখী/সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মার্কা দুটি থাকলেও প্রার্থী একই দলের। প্রশাসনের অভূতপূর্ব নিরপেক্ষতা ও সতর্কতার কারণে এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। প্রত্যেক ভোটার উৎসবমুখর পরিবেশে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ভোট দেয়ার তৃপ্তি পেয়ে উৎফুল্ল। অনেকের উচ্ছ্বাস আবেগমাখা উক্তি ছিল ‘এমন ভোট জীবনেও দেখিনি’। প্রশাসনের এমন প্রশংসনীয় কাজ নিঃসন্দেহে একটি অনন্য উদাহরণ। এর সর্বশেষ সংযোজন নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এ কথা আজ সর্বজনস্বীকৃত অনেকদিন পরে হলেও এ দেশে যে সুষ্ঠু সঠিক নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জ। এখানেও শত বাধা-বিপত্তি, চতর্মুখী স্বার্থ-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নৌকা পাড়ে ভিড়তে পেরেছে শুধু সঠিক সিদ্ধান্ত আর সকল ব্যক্তি সার্থের উর্ধে উঠে নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা এবং অনুগত্যের কারণে। এখন কথা হলো নৌকা বরাদ্দের ক্ষেত্রে নৌকার কা-ারিরা যদি সঠিক যাচাই বাছাই করেন, বাস্তবতার কষ্টিপাথরে প্রার্থীদের চরিত্র, কার্যকলাপ, সুনাম-দুর্নাম, জনপ্রিয়তা যাচাই করেন তা হলে হয়ত নৌকার সহজ পরাজয়ের কলঙ্ক সহজে ঘটবে না। একাধিক উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে নিশ্চিত বিজয়ী ব্যক্তি নির্ধারণ করা যেমন কঠিন তেমনি মনোনয়ন বাণিজ্য বলে একটি বিষয় বেশ আলোচিত। শোনা যায়, নৌকা নাকি কোথাও কোথাও অনেক চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। গায়েবের মালিক আল্লাহ। তবে গুঞ্জন অনেক সময় গুজবের চাইতেও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। এ ক্ষেত্রে নৌকার কা-ারিদের বাস্তবসম্মত দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা, নির্লোভ-নির্মোহ মানসিকতাই যে কোন বিপর্যয়ের বা কলঙ্কের হাত থেকে নৌকাকে রক্ষা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুধু নেত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। তাকে সহায়তা করা অনুগামী-অনুসারীদের ফরজ। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড [email protected]
×