বড় খালু এসেছে সিলেট থেকে। তার সঙ্গে বড় খালা, আবির আর আফসানা। বইমেলা থেকে বই কিনবে। তারা সন্ধ্যায় এসে পোঁছেছে। ওদের দেখে খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে তিন বছরের তিষা আর তিষার বড় ভাই অনীক। তিষা খালুকে খুব ভয় পায়। খালুর বড় বড় চশমা আর ডেবা ডেবা চোখ দেখে তিষা কাছে যায় না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। সে খালুর কোলে উঠে বসেছে। খালুর চশমা টেনে নিয়ে বলল, বইমেলায় আমিও যাব।
তুমিও যাবে?
হা তো, যাব।
অনীক ধমক দিয়ে বলল, এই তিষা তুই খালুর কোল থেকে নাম। তুই বইমেলার কি বুঝিস? নাম বলছি।
অনীকের শাসন দেখে খালু হাসে।
তিষা তিন বছরের হলে কী হবে? পাকামোতে সবার সেরা। সে আঙুল তুলে বলল, কী বলছো ভাইয়া? চুপ।
তিষার ধমক খেয়ে অনীক হতভম্ব। সে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর বলল, খালু, তুমি ওকে নিও না। ছোট মেয়েরা মেলায় হারিয়ে যায়।
অনীকের পাকা কথা শুনে খালু বেশ মজা পায়। দুই ভাইবোনের কথা শুনতে ভালোই লাগছে। এই সময় আবির আর আফসানা এসে বসে বাবার পাশে। ওরা জমজ ভাইবোন। ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওরা দুজন তিষার পক্ষ নেয়। আবির বলল, অবশ্যই তিষাও যাবে বইমেলায়।
অনীকের পক্ষে কেউ কথা বলল না দেখে সে মুখ গোমড়া করে মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করে। বাবাকে নালিশ করে লাভ নেই। বাবা সব সময়ই তিষার পক্ষে। মাকে বলল, তিষা মেলায় যে যাবে সে বইমেলার কী বুঝে? এটা কি পুতুলমেলা? হারিয়ে যাবে না, মা?
মা বুঝতে পারছে ভাইবোনের খুনসুটি। মনে মনে হেসে বলল, হারাবে কেন? তুমি ওকে দেখে রাখবে। আর আমরা সাথে থাকব না?
মায়ের কথায় অনীক খুশি হয়নি। ভরসা পায়নি। মনে জেদ চাপে। তিষার কাছে তাহলে হেরে যেতে হবে। এটা কি মেনে নেয়া যায়। সে বলল, আমি দেখে রাখতে পারব না। ওকে নেয়াটা মনে হয় ঠিক হবে না। মা অনীকের গাল টিপে আদর করে বলল, ওরে আমার টেটনা রে। ঠিক হবে না কেন? অবশ্যই ঠিক হবে। আমরা সবাই কাল বইমেলায় যাব। অনেক বই কিনব?
তিষা কি বই পড়তে পারে?
ওর জন্য ছবির বই কিনব। তিন বছরের শিশুদের ছবির বই পড়তে দিতে হয়।
মা আর অনীকের কথা শুনে বাসার কাজের মেয়ে লায়লা লাফ দিয়ে উঠল। আমিও বইমেলায় যাব খালাম্মা।
অনীক বলল, তুমি যাবে বইমেলা? জীবনে কোনো দিন বই পড়েছো?
পড়ি নাই তাতে কী? এখন পড়ব। অনীক বলল, আহ! যা বললে। মা বলল, তোর যাওয়ার দরকার নেই। তুই মেলায় গিয়ে কী করবে?
লায়লার মুখ ভার করে খালুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে খালুর দিকে। এই সময় বাসায় অনীকের বাবা ঢোকে। বাবা অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়। অন্যদিন তিষা বাবা বাসায় ফিরলেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজকে খালুর কোল থেকে নড়েনি। বাবা বুঝতে পেরেছে কোনো ঘটনা আছে। লায়লার মুখও ভার। খালু জিজ্ঞেস করল, তোমার মুখ কালো কেন লায়লা।
লায়লা বলল, আমিও যাব।
কোথায়?
বইমেলায়।
খালু বুঝতে পারছে লায়লাকে হয়তো মেলায় যেতে কেউ না করেছে। তাই মন খারাপ। তাকে সান্ত¦না দিয়ে খালু বলল, অবশ্যই যাবে। তোমাকেও নিয়ে যাব। অনীকের বাবা বুঝতে পারে, তিষার মতলব তাহলে বইমেলায় যাওয়া। এজন্যই খালুর কোল ছাড়ছে না। পরদিন বইমেলায় রওনা হয় সবাই। বাসা থেকেই বের হয়ে রাস্তায় নেমে অনীক তিষাকে সাবধান করে, সাবধানে থেকো কিন্তু। না-হয় হারিয়ে যেতে পারো। খুব ভিড় হয় কিন্তু। কথাটা মনে রেখো। অনীকের পাকা কথা শুনে সবাই হাসে। বিকেলে ওরা সবাই মেলায় পৌঁছায়। বইমেলার এক কোণে কোণে দাঁড়িয়ে খালু জিজ্ঞেস করল, কে কী বই কিনতে চাও বলো। আগে একটা লিস্ট করে কিনতে শুরু করব।
আফসানা বলল, আমি সায়েন্স ফিকশন কিনব।
আবীর বলল, আমি কিনব ভূতের বই।
তিষা বলল, আমিও ভূতের বই কিনব।
অনীক বলল, আশ্চর্য মেয়ে তো! তুমি কি পড়তে পারো? তুমি কিনবে ছবির বই।
অনীকের কথায় তিষা চিন্তায় পড়ে যায়। পরে ঠিক হলো তিষা ছবির বইই কিনবে।
খালু বলল, আচ্ছা। তোমাদের পছন্দ মতোই কিনা হবে। লায়লা তুমি কি বই কিনবে?
লায়লা বলল, আমি কিনব গল্পের বই। আর ছড়ার বই।
দল বেঁধে ওরা বই কিনতে যায়। অনীক হঠাৎ মাঠের মাঝখানে একজন লেখককে দেখতে পায়। অনেক মানুষ ভিড় করে ওনার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। অনীক বলল, খালু আমাকে একটা বই কিনে দাও। আমি ওনার অটোগ্রাফ নেব।
তিষা বলল, অটোগ্রাফ কী?
অনীক বলল, অটোগ্রাফ বুঝলে না। অটোগ্রাফ মানে হলো অটোগ্রাফ। বুঝেছো।
তিষা মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি। তুমি আমাকে অটোগ্রাফ দিবে। আবির বলল, যা বললে। ও কি লেখক? তিষা বলল, কেন, খাতায় লিখে না? ভাইয়া আমাকে অটোগ্রাফ দিবে। খালু সবাইকে থামতে বলে বলল, এবার বই কেনার পালা,চলো। বিভিন্ন স্টল ঘুরে অনেক বই দেখে কেনা হচ্ছে। অনীক একটা গল্পের বই নিয়ে দৌড়ে মেলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা লেখকের কাছে। অটোগ্রাফ নিতে। এক ফাঁকে তিনি পুব পাশে চলে যান। অনীক সেদিকে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করে। এক সময় লেখকে পায় নি। আর মা-বাবা, খালা-খালু, তিষা, আবির, আফসানা, লায়লা কাউকে সে খুঁজে পায় না। অনীক বুঝতে পেরেছে সে হারিয়ে গেছে।
ওদিকে ওরাও অনীককে না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে। কোথায় গেল অনীক? মা আর বড় খালা অনীকের জন্য কান্না শুরু করে দিল। অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ। অনীক ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চিন্তা করে, কী করা যায়? একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। সে লক্ষ করে কোথা থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। ওরে বাবা সেটি তো বাংলা একাডেমির ভিতরে। অনীক বুদ্ধি করে সেখানে চলে যায়। মাইকে যিনি ঘোষণা দিচ্ছেন তাকে গিয়ে বলে, আমি হারিয়ে গেছি। মাইকে একটু বলে দেন তো।
অনীকের কথা বলার ঢং দেখে ঘোষণাকারীর হেসে দিলেন। এখন হাসির সময় না। একটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলে হারিয়ে গেছে। ঘোষণাকারী জিজ্ঞেস করল, কী বলব বাবু?
অনীক বলল, বলুন, অনীক নামের একটি ছেলে হারিয়ে গেছে। সে এখানে আছে। তাকে এসে নিয়ে যান। অনীকের কথা শুনে ঘোষণাকারী বেশ মজা পান। আবার সাহস দেখে অবাকও হন। তিনি বললেন, তুমি আমার পাশে দাঁড়াও। একদম নড়বে না। ঘোষণাকারী সুন্দর করে গুছিয়ে ঘোষণা দেন। কিছুক্ষণ পরেই বাসার সবাই এসে অনীককে উদ্ধার করে। মায়ের কান্না থামে। বড় খালার কান্নাও থামে। তিষা বলল, কে হারায় ভাইয়া?
অনীক বলে, চুপ। খালু বলল, আর কথা নয় অনীক। অনেক হয়েছে। এখন চলো বই কিনে বাসায় ফিরি। তোমরা আমাদের হাত ছেড়ে যেতে পারবে না। অনীক তুমি বাবার হাত শক্ত করে ধরো। সবাই মিলে পছন্দের সব বই কিনল। অনেক বই। বড় খালু সবাইকে অনেক বই কিনে দিল।
এতো বই দেখে সবার মন আনন্দে ভরে গেল।
অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন