ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

সংরক্ষণবাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বায়নের পক্ষে চীন

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সংরক্ষণবাদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বায়নের পক্ষে চীন

গত ১৭ জানুয়ারি সুইস রিসোর্ট ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক কোরামে চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিন পিংকে প্রতিনিধিরা যেভাবে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছিলেন তা ছিল এক কথায় অসাধারণ। বিশ্বের রাজনৈতিক ও ব্যবসায় জগতের এলিটদের এই বার্ষিক সমাবেশে এই প্রথম চীনের একজন প্রেসিডেন্ট যোগ দিলেন। প্রেসিডেন্ট জি পিং ভাষণ দেয়ার সময় গোটা হলটি ছিল দর্শক-শ্রোতায় ঠাসা। তার ভাষণে নতুনত্ব যা কিছু ছিল তা সামান্যই। তথাপি প্রতিনিধিরা ঘন ঘন করতালির দ্বারা সে ভাষণকে অভিনন্দিত করেছিলেন। বিশ্বব্যাপী পুঁজিপতিদের জন্য যে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে তার পটভূমিকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কমিউনিস্ট নেতা নিজেকে বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজারের প্রবক্তা হিসেবে যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন তাতে প্রতিনিধিরা নিদারুণ স্বস্তি খুঁজে পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জি পিং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বনামে উল্লেখ করেননি। এমনকি আমেরিকার নামও নয়। তবে তার বার্তাটি ছিল পরিষ্কার। সেটা হলো ‘বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হবে না।’ কথাটা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশে চপেটাঘাত। কারণ ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যে চীনা পণ্যের ওপর অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যবস্থার মধ্যে কঠোর শুল্ক আরোপ করা হবে। মি. জি এই সংরক্ষণবাদী নীতিকে ‘নিজেকে অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখার সঙ্গে তুলনা করেছেন।’ কথাটা সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের বেশ পছন্দ হয়েছে এবং তারা বার বার সানন্দে এই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। মি. জি দ্বন্দ্বময় বিশ্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিস’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘ওটা ছিল শ্রেষ্ঠতম সময়, ওটা ছিল নিকৃষ্টতম সময়।’ বিদেশী অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে থাকেন যে, চীনেও সংরক্ষণবাদের উত্থান ঘটেছে বলে তারা মনে করেন। তবে এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, মি. জির বক্তব্যের বিষয় ছিল ডাভোস সম্মেলনের মেজাজের সঙ্গে বেসুরো। বরং তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, চীন তার দরজা হাট করে খোলা রাখবে এবং তা বন্ধ করবে না। চীনের প্রেসিডেন্ট তার দেশকে পরিবেশ সংরক্ষণের দৃঢ় সমর্থক বলে উল্লেখ করে বলেন যে, গত বছরে কার্যকর হওয়া জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্যারিস চুক্তির প্রতি দৃঢ় অবিচল থাকা একটাই দায়িত্ব তা ভবিষ্যত প্রজন্মগুলোর জন্য আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।’ শ্রোতাদের অনেকের কাছে এই কথাগুলোও বেশ আবেদন সৃষ্টি করে। প্যারিস চুক্তি প্রত্যাখ্যানে ট্রাম্পের হুমকি এই চুক্তির প্রতি চীনের অঙ্গীকারকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট জি পিং ডাভোস সফরে যা কিছু অর্জন করেছেন তার জন্য তিনি নিশ্চয়ই পরিতৃপ্তবোধ করতে পারেন। তার সামনে রয়েছে রাজনৈতিক লড়াই। শরতে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচ বছরমেয়াদী নতুন কংগ্রেসের নির্বাচন। সেই নির্বাচনের জন্য তিনি এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কংগ্রেস হয়ে যাওয়ার পর তিনি সরকারে রদবদল ঘটাবেন। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তিনি তাঁর অধিকতর মিত্রদের বসাবেন। ডাভোস সম্মেলনে তার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সহকর্মীদের এই বক্তব্যই আরও জোরাল হলো যে চীনের অর্থনীতির দায়-দায়িত্ব তারই হাতে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম হলো এমন এক জায়গা যেখানে চীনের রাজনীতি নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন কদাচিৎই প্রকাশ্যে তোলা হয়। মি. জি পিং চীনের মুক্তদ্বার নিয়ে অবলীলায় বলে যেতে পেরেছেন। ভিন্নমত দমন ও ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ কেন কড়াকড়ি করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয় তেমন একটা পেতে হয়নি। গত ১৪ জানুয়ারি চীনের জ্যেষ্ঠতম বিচারক বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতাকে পাশ্চাত্যের মেকি আদর্শ বলে নিন্দা করেছিলেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে এর আগে চীনের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীরাই যোগদান করেছিলেন। ২০১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট লি ইউয়ানচাও চীনা দলের নেতৃত্ব করেন। তিনি অবশ্য পার্টিতে ব্যাংকের দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিচে। প্রশ্ন হলো প্রেসিডেন্ট জি পিং এই সম্মেলনে যোগ দিতে তার কার্যকালের শেষ বছরটি পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করলেন? তিনি হয়ত সম্মেলনে যাওয়ার ভাবনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন কয়েকটি বাস্তব কারণে। যেমন গত বছর চীনে শেয়ার বাজারে ধসের পর অর্থনীতিতে মন্থরতা দেখা দিয়েছিল। চীনা মুদ্রা ইউয়ানেরও সহসা অবমূল্যায়ন ঘটেছিল। এসব ইস্যু নিয়ে আলোচনা সম্মেলনে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। জি পিংকে অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। এসব কারণেই হয়ত তিনি গত বছর যাননি। অনেক পর্যবেক্ষক এখনও চীনের অর্থনীতি এবং সেই সঙ্গে এর ক্রমবর্ধমান ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তথাপি ডাভোস সম্মেলনে পাশ্চাত্যের সমস্যাবলীই প্রাধান্য পেয়েছে, চীনের নয়। অবশ্য যত আশাব্যঞ্জক কথাই বলুন না কেন, প্রেসিডেন্ট জি পিং বিশ্বের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চাওয়ার কোন লক্ষণ দেখাননিÑ এমনকি ট্রাম্প এই দায়িত্ব বর্জন করার পরও নয়। তিনি শুধু এটা দেখাতে চেয়েছেন যে এই গোলযোগময় বিশ্বে চীনের স্থিতিশীলতা পাথরের মতো অটুট। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×