ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যাকা-ের তদন্তের মোড় ঘুরে যাচ্ছে

বাদী সাবেক এসপি বাবুলকে শেষ পর্যন্ত মূল আসামি করা হতে পারে!

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাদী সাবেক এসপি বাবুলকে শেষ পর্যন্ত মূল আসামি করা হতে পারে!

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে সংঘটিত সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু’র চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের তদন্তের মোড় শেষ পর্যন্ত ঘুরে যাওয়ারসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ মামলার বাদী স্বামী বাবুল আক্তার নিজে হলেও তাকেই এ মামলার মূল আসামি করা হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তদন্ত সংস্থা সিএমপির ডিবির পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তা এডিসি কামরুজ্জামান তদন্ত সম্পন্ন করার বিষয়ে এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে খোদ বাবুল আক্তার, তার শ্বশুর, শাশুড়ি এবং তার ভাই ছাড়াও আসামি এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যা উদঘাটন করেছেন তা বাবুল আক্তারের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে গেলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামের ব্যস্ততম জিইসি মোড় এলাকায় পুত্রকে স্কুলগামী বাসে তুলে দিতে গিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে একটি কিলার গ্রুপ মিতুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যাকারীদের অধিকাংশ বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। যার নেতৃত্বে এ কিলিং মিশন সম্পন্ন হয়েছে সেই মুসা ছাড়া বাকি ৭ জন সবাইকে আটকের পর ২ জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। পুলিশ মুসাকে পলাতক হিসেবে বলে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী মুসা গুম হয়েছে। কিভাবে গুম বা হত্যা করা হয়েছে তাও রহস্যাবৃত। অবশিষ্ট যে ৫ জন বর্তমানে জেলে রয়েছে তন্মধ্যে হত্যাকা-ে অস্ত্র সরবরাহকারী এহতেশামুল ভোলা ওরফে ভোলাইয়ার জামিন মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে নাকচ হয়েছে। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন ও মা শাহেদা মোশারফ হত্যাকা- ঘটনার পর পর যে গোলক ধাঁধায় ছিলেন এখন তারাও সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গত প্রায় দু’মাস ধরে বাবুল আক্তার ও তার দু’সন্তানের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগও নেই। অথচ, হত্যাকা-ের পর বাবুল ঢাকায় শ্বশুর মোশারফের বাসায় সন্তানদের নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা তাকে (বাবুল) একবার, শ্বশুর মোশারফকে দু’বার এবং শাশুড়ি শাহেদা মোশারফকে একবার ও বাবুলের ছোট ভাইকে একবার ঢাকা থেকে ডেকে এনে সিএমপি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। মিতু হত্যাকা-ের পর বাবুল তার এজাহারে সন্দেহজনক অজ্ঞাতনামা ৩ জনের নামে এফআইআর করেন। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, এই ৩ জনই বাবুলের মূল সোর্স। যার মধ্যে মুসা অন্যতম। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের চেনার পরও বাবুল কেন তাদের অজ্ঞাতনামা হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা রহস্যময় হয়ে আছে। এ হত্যাকা-ের পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং সাহসী পুলিশ অফিসার হিসেবে চিহ্নিত বাবুল আক্তারের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। বাবুলও তখন উল্লেখ করেছিলেন, জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা এ হত্যাকা- ঘটাতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তদন্তে তার বিপরীত চিত্র উঠে আসতে থাকে। তদন্তে এ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে কোন জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্য এ ঘটনা ঘটায়নি। সন্দেহের তীর বরাবরই বাবুলের দিকেই যাচ্ছে। মিতুর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ উঠলেও এখন খোদ বাবুলের বিরুদ্ধে পরকীয়ার নানা চিত্র বেরিয়ে আসছে। এ প্রক্রিয়ায় উভয়ের বিবাহিত জীবন সুখকর ছিল না যে তা তদন্তে নিশ্চিত ধারণা পাওয়া গেছে। যে সকল আসামি কিলিং স্কোয়াডে জড়িত ছিল তারা পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে পরোক্ষভাবে বাবুলের দ্বারাই ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বললেও পুরো বিষয়টি একমাত্র মুসারই জানা বলে বক্তব্য দেয়। মুসার স্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিল তার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে সেই মুসার আর কোন খবর নেই। অসমর্থিত বিভিন্ন সূত্র মতে, মুসাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তা গুম না হত্যা তা রহস্যময়। এদিকে, পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে বাবুলকে নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য রয়েছে। কোন কোন সূত্রে বলা হয়েছে, বাবুলকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু রহস্যময় ইশারায় তিনি দীর্ঘ পনের ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে থেকে ছাড়া পেয়ে যান। তখন তার শ্বশুর-শাশুড়ির অবস্থানও ছিল বাবুলের পক্ষে। কিন্তু পরবর্তীতে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকায় এখন তাদের কথাবার্তায়ও সন্দেহের তীর বাবুলের দিকে। এ অবস্থায় তদন্তসংস্থা ডিবির পক্ষে অস্ত্র সরবরাহকারী ভোলাইয়ার ১৬৪ ধারায় কেন জবানবন্দী নেয়ার ব্যবস্থা করেনি তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মিতু হত্যাকা-ের পর দুটি মামলা হয়। একটি অস্ত্র আইনে ও অপরটি হত্যাকা- নিয়ে। মঙ্গলবার হত্যাকা-ের আসামি হিসেবে ভোলাইয়ার জামিন চান তার আইনজীবীরা। কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দিয়েছে। এই ভোলাইয়া আগেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে সে মুসাকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর অস্ত্রটি যার হেফাজতে ছিল তাকেও আসামি ও গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা এডিসি কামরুজ্জামান এ সংক্রান্তে সরাসরি মুখ খুলছেন না। তবে যে সমস্ত তথ্য উপাত্ত তিনি পেয়েছেন তার কিছু অংশ মিতুর বাবা মোশারফ ও মা শাহেদা মোশারফকে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন কয়েক আসামির বক্তব্যের ভিডিও চিত্র। এসব ভিডিও চিত্র দেখার পর মিতুর বাবা ও মা উভয়ই কান্না করেছেন এবং এতোদিন তারা যে ধারণা নিয়ে ছিলেন সে ধারণার অপমৃত্যু ঘটে। সঙ্গতকারণে, সর্বশেষ সিএমপি কার্যালয়ে আসার পর তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন মিতু হত্যাকা-ে বাবুলের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাকেও আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। প্রসঙ্গত, মিতু হত্যাকা-ের পর থেকে কোন অবস্থাতেই বাবুলকে যেন এ মামলায় সংশ্লিষ্ট করা না হয় তা নিয়ে প্রভাবশালী একটি গ্রুপ কাজ করছে। কেন করছে তা অজ্ঞাত। কারও কারও মতে, বিষয়টি একজন পুলিশ কর্মকর্তা তথা এসপি পদমর্যাদার অফিসার নিয়ে। সঙ্গত কারণে বিষয়টি সমগ্র পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তির ব্যাপার। ফলে এ ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা নাটক চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, বাবুল যদি এ ঘটনায় জড়িত না থাকেন তাহলে স্ত্রী হারানোর পর তিনি কেন পদত্যাগ করলেন। একমাসেরও বেশি এ পদত্যাগপত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় রেখে দিয়ে পরে তা কেন গ্রহণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন। একদিকে স্ত্রী হত্যাকা-, তার ওপর নিজে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার বিষয়টি সামগ্রিকভাবে সন্দেহকে আরও তীব্র করেছে। এখন সরকারের উঁচু মহলের পক্ষে নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু কেউ এ সংক্রান্তে কোন দায়িত্ব নিতে অপারগ। তবে তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামানের জন্য মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থা। মিতু হত্যাকা-ের পর পুলিশের পক্ষে তদন্তে সহায়তার জন্য যে ৫টি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছিল সে সব কমিটির সদস্যরা অভিন্ন সুরে তখন থেকেই বলে আসছিলেন এ ঘটনার মূল নায়ক স্বামী বাবুল আক্তার নিজে। কারণ ঘটনার পর পর সব আসামি আটক হওয়ার সুবাদে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা বিষয়টি নিশ্চিত হন। আসামিদের বক্তব্য এবং তাদের সশরীরে ঢাকায়ও প্রেরণ করা হয়। সেখানে ডিআইজি পদমর্যাদার তিন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হন এবং পরে বাবুলকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং আসামিদের মুখোমুখি করার পর বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন। কারণ, তাকে দুটি অপশন দেয়া হয়েছিল। যার একটি হচ্ছে গ্রেফতার, অন্যটি হচ্ছে পদত্যাগ। তিনি পদত্যাগই বেছে নেন। পরবর্তীতে তা কার্যকর হয়। সঙ্গত কারণে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মিতু হত্যাকা- নিয়ে তদন্ত বেশিদূর এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজন নেই। আসামি শনাক্ত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে। তাদের বক্তব্য পাওয়া গেছে।
×