ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাদল মিয়ার জন্য শোক

শিশুকে বাঁচাতে জীবন উৎসর্গকারীর বাড়িতে মাতম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

শিশুকে বাঁচাতে জীবন উৎসর্গকারীর বাড়িতে মাতম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এক অবুঝ শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন অবলীলায় উৎসর্গকারী দুঃসাহসী রেলকর্মী বাদল মিয়ার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতের পরিবার আর আত্মীয়স্বজনদের গগণবিদারী আর্তনাদে ভারি হয়ে আছে সেখানকার আকাশ বাতাস। সাহসী বাদল মিয়াকে একনজর দেখার জন্য শত শত মানুষ ভিড় করেছিল তার বাড়িতে। অনেকেই সেখানে গিয়ে নিহতের পরিবারকে নানাভাবে সান্ত¡না দিচ্ছেন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন স্তরের লোকজন, রেল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও হাজির হয়েছিলেন বাদল মিয়ার বাড়িতে। মহৎ প্রাণ বাদল মিয়ার তৃতীয় জানাজায় ঢল নেমেছিল মানুষের। জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ির করবস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন মহত্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাদল মিয়া। গ্রামের বাড়ির মানুষের মুখে মুখে ফিরছে বাদল মিয়ার মমত্বভরা মহৎ সাহসিকতার কথা। এদিকে বাদল মিয়ার এমন সাহসিকতার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ গর্ব অনুভব করছে। তাই কর্তৃপক্ষ বাদল মিয়ার পরিবারের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। কর্তৃপক্ষ বাদল মিয়ার দুই ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। রেল বিভাগে অস্থায়ীভাবে কর্মরত থাকা মামুন মিয়াকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি, নিহতের বড় ছেলে জজ মিয়াকে রেল বিভাগে চাকরি প্রদান এবং নিহতের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার চিন্তা ভাবনা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। আজ উর্ধতন কর্মকর্তারা কমলাপুর রেল অফিসে বাদল মিয়ার দুই ছেলের সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলবেন। দুই ছেলেকে রেল বিভাগের কর্তা-ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নিয়ে যেতে বলেছেন। ঘটনার পর পরই রেল বিভাগ নিহত বাদল মিয়ার দাফন কাফনের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছেন পরিবারকে। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার দুপুর একটার দিকে রেললাইন ও ট্রেনের মেকানিক বাদল মিয়া (৫৮) কাজের ফাঁকে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করতে কুড়িল বিশ্বরোডের একটি মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই সময় রেললাইন পার হচ্ছিল ৫/৬ বছরের একটি শিশু। এ সময় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সুরমা এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাচ্ছিল। স্থানীয়রা জানান, তারা দেখতে পাচ্ছিলেন শিশুটি ট্রেনে নির্ঘাত কাঁটা পড়ছে। চোখের পলকে বাদল মিয়া রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে রেললাইনের বাইরে পার করে দিয়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিজে রেললাইন পার হতে পারেননি। দ্রুত গতির ট্রেনের ধাক্কায় ও কাটা পড়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় বাদল মিয়ার শরীর। মহৎ বাদল মিয়ার নিথর দেহ পড়ে থাকে রেললাইনের উপরে। বাদল মিয়ার রক্তে রাঙা হয় রেলপথ। মুহূর্তেই এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা ছুটে যান। বাদল মিয়ার লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নেয়া হয় কমলাপুর রেল অফিসে। সেখানেই প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রেল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় খিলক্ষেতের কাওলা রেল বিভাগের স্টাফ কোর্য়াটারে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর পরিবার লাশ নিয়ে রাতেই গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। বাদল মিয়ার পিতার নাম মৃত হাতেম আলী। বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার মুখী গ্রামে। জন্মস্থান মুখী গ্রামে যখন বাদল মিয়ার লাশ পৌঁছে সেখানে চলছিল গগনবিদারী আর্তনাদ। বাদল মিয়ার ছোট তিন ছেলের কান্না দেখে সবার চোখেই তখন জল ঝরছিল। নিহত বাদল মিয়ার মেজো ছেলে খিলক্ষেত রেললাইনের অস্থায়ী গেটকিপার মামুন মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, তারা পাঁচ ভাই তিন বোন। বড় ভাই জজ মিয়া একটি বেসরকারী নিরাপত্তা কোম্পানিতে ছোটখাটো চাকরি করেন। তার ঘরে স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। এরপর তিনি। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। মা আয়েশা বেগম গৃহিণী। অভাবের সংসারে ছোট ছোট তিন ভাই সোহাগ, সোহেল ও রিমেল পড়ালেখা করে। শনিবার বেলা এগারোটার দিকে তৃতীয় জানাজা শেষে গ্রামের করবস্থানে বাবাকে দাফন করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা তাকে ও তার বড় ভাই জজ মিয়াকে ঢাকার কমলাপুর রেল অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন। রবিবার দুপুরে উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি রেল কর্তৃপক্ষের কাছে কর্মরত থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে নিয়মানুযায়ী যে অর্থ পেয়ে থাকে, তা পাওয়ার আশা করেন। পাশাপাশি অভাবে থাকা তার বড় ভাই জজ মিয়াকে রেল বিভাগে একটি স্থায়ী চাকরি এবং রেল বিভাগে অস্থায়ী পদে কর্মরত তাকে স্থায়ী করার অনুরোধ জানান। তাহলে পরিবারটি কোনমতে টিকে থাকতে পারবে। অন্যথায় খুবই অসুবিধা হবে। যদিও ইতোমধ্যেই রেল কর্তৃপক্ষ নিহত পিতার জন্য তাঁর পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবই করা হবে জানিয়েছেন। এদিকে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের ওসি ইয়াছিন ফারুক জনকণ্ঠ জানান, উদ্ধার হওয়া সেই শিশুটি এবং তাদের মায়ের হদিস মেলেনি। মা ও শিশুটিকে ভাসমান মানুষ বলে ধারণা করা হচ্ছে। হয়তো অজানা আশঙ্কায় শিশুটিকে নিয়ে মা অন্যত্র চলে গেছেন।
×