ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় রূপপুরে

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৭

পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা  বলয় রূপপুরে

মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্য প্রয়োজন বিদ্যুতের সস্তা ও সহজলভ্য প্রাপ্তি। বিদ্যুত উৎপাদনের সঙ্গে আবার কার্বন নির্গমন ও পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও জড়িত। তাই বিদ্যুত উৎপাদনের উৎস নির্বাচনে হাল আমলে পরিবেশ সংরক্ষণের দিকটি বিবেচনায় নিতে হয়। এক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার তথা পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন পরিবেশ ও প্রতিবেশবান্ধব। এসব দিক বিবেচনায় শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জ্বালানি-নীতিতে নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের অপশনটি যুক্ত করেন। আর এর বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, আজকের রুশ ফেডারেশনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। যা ছিল বাঙালী জাতির পঞ্চাশ বছরের স্বপ্ন। কিন্তু পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন অত্যন্ত সেনসেটিভ। এক্ষেত্রে উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় বিধায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে। কারণ এর সামান্য ব্যত্যয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ, ইকোলজির সমূহ ক্ষতি ও ব্যাপক প্রাণহানিসহ দীর্ঘমেয়াদে প্রকট সমস্যার আশঙ্কা দেখা দেবে। আর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে নবাগত রাষ্ট্র দেশ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা সত্যিই বাংলাদেশের জন্য এক চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই মোকাবেলায় পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আর তাইতো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) গাইডলাইন অনুসরণ করা হচ্ছে। সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিবেশী দেশ ভারতের। উল্লেখ্য, ভারতে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বর্তমানে ২২টি পারমাণবিক চুল্লি চালু আছে। আরও ৫টি নির্মাণাধীন এবং ৩৩টি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, নির্বাচন করা হয়েছে রুশ ফেডারেশন নির্মিত বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে নিরাপদ ও সর্বাধুনিক থ্রি-প্লাস প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর-ভিভিইআর-১২০০। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, রি-এ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়নে এ পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য নির্বাচিত পারমাণবিক চুল্লিতে নিম্নবর্ণিত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় থাকবে। ফুয়েল প্লেট : নিউক্লিয়ার রি-এ্যাক্টরের পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রথমটি হচ্ছে ফুয়েল প্লেট। সাধারণত ইউরেনিয়াম অক্সাইড ফুয়েল প্লেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা অতি উচ্চ তাপমাত্রায় তার জ্বালানি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। ফুয়েল প্লেট সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয়, ফলে তেজস্ক্রিয়তা প্লেটের ভেতরে অবস্থান করে। ফুয়েল ক্ল্যাডিং : ফুয়েল প্লেটগুলো জিরকোনিয়াম এ্যালয়ের তৈরি ফুয়েল ক্ল্যাডিং দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। ফলে ফুয়েল প্লেটগুলো চারপাশের উষ্ণ পানির সংস্পর্শ থেকে মুক্ত থাকে। বিশেষ কোন কারণে যৎসামান্য তেজস্ক্রিয়তা ফুয়েল প্লেট থেকে বের হয়ে এলেও তা এই ফুয়েল ক্ল্যাডিং ভেদ করতে পারবে না। রি-এ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল : নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের জন্য বিশেষ মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পুরু ইস্পাতের প্রেসার ভেসেল তৈরি করা হয়, যা উচ্চ তেজস্ক্রিয় অবস্থাতেও দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং : ভারি ধাতব বা রি-ইনফোর্সমেন্ট কনক্রিট দিয়ে ১.২ মিটার পুরুত্বের প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করা হয়। যা প্রথমত ফিশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে এবং দ্বিতীয়ত বাইরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিমান দুর্ঘটনা ইত্যাদি থেকে প্লান্টকে রক্ষা করে। দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং : নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিকতর জোরদার করার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং-এর পর ০.৮ মিটার পুরুত্বের আরও একটি কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং যুক্ত করা হয়, যা যে কোন পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয়তাকে পরিবেশে ও নিকটবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে। উপর্যুক্ত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের কারণে মানবসৃষ্ট ঘটনা-দুর্ঘটনা যেমনÑ সন্ত্রাসী বা জঙ্গী হামলা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদির প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষম থাকবে এই পারমাণবিক চুল্লি। এই পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ছাড়াও এই প্লান্টের ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে রিখ্টার স্কেলে ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্পেও রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কোন ক্ষতি হবে না। এছাড়া ৫ টন পর্যন্ত ওজনের এয়ার ক্রাফটের আঘাতেও এটি অক্ষত থাকবে। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসীদের বিমান হামলার পর থেকে দেশে-দেশে নির্মিতব্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের নিরাপত্তা ইস্যুতে এই অপশনটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর্যুক্ত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় সুনিপুণভাবে বাস্তবায়নে আন্তঃসরকার জেনারেল কন্টাক্ট অনুযায়ী কাজ করছে এ-প্রযুক্তিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ রুশ ফেডারেশন। মজার বিষয় হলো, সর্বশেষ প্রজন্মের ও অত্যাধুনিক নিরাপত্তার সংবলিত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে রি-এ্যাক্টর বিল্ডিং থেকে ৮০০ মিটারের মধ্যে যেটা মূলত ‘এক্সক্লুসিভ জোন’ বলে পরিচিত বাইরের স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যাবে। এই এলাকায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত কর্মীদের জন্য উন্নতমানের আবাসিক ভবন, স্কুল-কলেজ প্রভৃতি স্থাপন করা হয়ে থাকে। নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমাদের দেশে কোন পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নেই বিধায় এই তথ্যটি হয়ত কারও-কারও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনকারী দেশসমূহে এই পরিবেশই বিদ্যমান। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ও গবেষক
×