ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মা কেন সন্তান হত্যা করে আত্মঘাতী হচ্ছেন-

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

মা কেন সন্তান হত্যা করে আত্মঘাতী হচ্ছেন-

আজাদ সুলায়মান ॥ বাবার যে আয়-তাতে সংসারের টানাপোড়েন থাকতেই পারে। এ নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া বিবাদ দেখা দিলে সন্তানের দোষ কোথায়? দুর্ভাগ্যের বিষয়-কোন দোষ না থাকলেও বাবা-মায়ের সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে নিষ্পাপ সন্তানদেরই। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট বাবার ব্যর্থতা ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গর্ভধারিণী মা-ই হয়ে ওঠেন খুনী। নিজ হাতে গলাটিপে হত্যা করেন কোলের শিশুকে। তাতেও রাগ-জেদ না মিটলে নিজেই কেড়ে নেন নিজের প্রাণ। কিংবা নেশাগ্রস্ত সন্তান টাকা না পেয়ে মায়ের গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা যেমন ঘটছে, তেমনি পরকীয়ায় আসক্ত নারীও ডাইনী হয়ে ওঠে সন্তানের ওপর। অভাবের তাড়নায়ও বাবা হয়ে ওঠে ঘাতক। এ রকমটি যে শুধু এক-দু’বার ঘটেছে তা নয়। মিরপুর থেকে বনশ্রী, গাইবান্দা থেকে ফেনী, কোথায় না ঘটছে। গত তিন মাসে শুধু রাজধানীতেই ঘটেছে মায়ের হাতে সন্তান হত্যার তিনটি ঘটনা। ঢাকার বাইরে ঘটেছে আরও দুটো ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে- কেন অপরাধজগতে এই নতুন মাত্রা যোগ? এটা কি সামাজিক অবক্ষয় নাকি ব্যাধি? নাকি উন্মত্ত ফ্যাশন? পুলিশ, অপরাধবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানিদেরও ভাবিয়ে তুলেছে অপরাধ জগতের এই লোমহর্ষক হত্যাকা-। এ ধরনের অপরাধ নিয়ে গবেষণার কাজে লিপ্ত বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়- গত বছর ৬০, এর আগের বছর ৪০ ও ২০১৩ সালে ১১টি শিশু প্রাণ হারিয়েছে এ জাতীয় ঘটনায়। এ সব হত্যাকা-ের মূলে ছিল- মা-বাবার দাম্পত্য কলহ, বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক, মাদকাসক্ত অবাস্তব চাহিদা। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুরের দিয়াবাড়ি এলাকায় দুই শিশু সন্তানকে নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যার পর মা নিজেই নিজের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আনিকা নামধারী এই মা এতটা ভয়ঙ্কর খুনী হয়ে উঠতে পারেন- এটা তার প্রতিবেশীরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। পুলিশ জানিয়েছে, আনিকা বিন্দুুমাত্র দ্বিধা করেননি নিজ হাতে শিশু দুটোকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে। গত ফেব্রুয়ারিত রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকায় নুসরাত আমিন অরনী (১৪) ও আলভী আমান (৬ ) নামের দুই শিশুর মরদেহ পাওয়া যায় তাদের বেডরুমে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও ত্্্াদের মা মাহফুজা মালেক জেসমীন পুলিশকে জানান, বাচ্চাদের স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হবার হতাশায় তাদেরকে নিজ হাতে খুন করেন। পরে পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে আসে- মায়ের পরকীয়ায় পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় সন্তান দুটো। তাই তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধাই ছিল তার উন্মত্ত প্রতিজ্ঞা। প্রেমিকের ইচ্ছাতেই মাহফুজা এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। গত ১২ ডিসেম্বর ফেনীর উকিলপাড়ায় দুই শিশু সন্তান মাহিন আহমেদ (৪) ও তাসনীম আহেমদ মাহীকে (৮) গলায় বৈদ্যুতিক তার ও গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করেন মারজিনা আকতার মুক্তা (২৩) নামের এক পাষ- মা। পুলিশী তদন্তে উঠে আসে এই মায়েরও খুনী হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল দাম্পত্য ও পারিবারিক কলহ। মিরপুরের দিয়াবাড়িতে নিজ হাতে বটি দিয়ে কিভাবে সন্তান দুটোকে হত্যা করতে পারল আনিকা-এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারেননি থানায় রিমান্ডে থাকা তার স্বামী শামীম হোসেন। উল্টো তিনি পুলিশের কাছে জানতে চান-সত্যি সত্যিই আনিকা সন্তান দুটোকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যা করেছে- নাকি অন্য কিছু। শামীমের মতো আনিকার পরিচিতজনদেরও প্রশ্ন, কি করে সম্ভব এটা। ষাটোর্ধ রিজিয়ার প্রশ্ন- নিজ হাতে নিজের প্রাণাধিক সন্তানের গলায় ছুরি চালানো এতই সহজ? যে সন্তানকে দশমাস গর্ভে ধারণের পর নাড়ি ছিঁড়ে দুনিয়াতে নিয়ে আসা হয়, যে সন্তানের মুখ দেখলে মায়ের সব দুঃখ বেদনা মুহূতেই উপশম ঘটে, সেই সন্তানের গলায় কি করে মা ছুরি চালান, কি করে তার গলা টিপে ধরেন? মা কেন এতটা পাষ- হয়ে ওঠেন ? রিজিয়ার জ্জ্ঞিাসা-আনিকা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন শামীমকে। টানা পোড়েনের সংসারেও সুখ ছিল, ছিল দুটো সন্তান, আরও একজন ছিল গর্ভে। কিন্তু এমন কি মনের দুঃখ ছিল তার যেটা সহ্য করতে না পেরে নিজে দুটো শিশু সন্তানকে মেরে নিজেও দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ফাঁসিতে ঝোলার আগে আনিকা নিজেই লিখেছেন চিরকুটে- “স্বামীর একটি ভুলে এই পথ বেছে নিলেন।” কি সেই ভুল? পুলিশের তদন্তে দেখা যায়, ঘটনার দিন সকালে ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে স্বামী তার মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। তারপর স্বামী বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে বর্বোরচিত কায়দায় সন্তানদের হত্যা করেন। তারপর নিজে ফাঁসিতে ঝোলেন। আনিকার মতো এক তরুণী মা কেন পাষ- হয়ে উঠলেন তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছে না প্রতিবেশীরা। পাশের ঘরেরই এক ভাড়াটে ফরিদা বলেন, মানলাম স্বামী না হয় একটা থাপ্পড় মারলই তাকে। এ জন্য কি নিজ হাতে দুটো ছেলেকে জবাই করতে হবে? একটা থাপ্পড়ের যন্ত্রণা কি দশ মাস গর্ভধারণের পর প্রসববেদনার চেয়েও বেশি? খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী আতিক সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, মনোবিজ্ঞানের জনক সিগমন্ড ফ্রয়েডের তত্ত অনুযায়ী মানুষের মাঝে তিনটি বিষয়- আইডি, ইগো ও সুপার ইগো থাকে। আইডির প্রভাব থাকলে মানুষ আদিম মনোবৃত্তির হয়ে যে কোন পশুত্বের কাজ করতে পারে। তার মাঝে তখন কোন বিবেকবোধ থাকে না। ইগো থাকলে মানুষ বিবেকবান, সচেতন ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হয়। সুপার ইগোর প্রভাবে বিবেক ও আদিমতা দুটোরই সমন্বয় থাকে। আতিক সোবহান বলেন, মিরপুরের সন্তানহন্তারক মা আনিকার কেস স্টাডিতে দেখতে হবে তার জন্ম, শৈশব, কৈশোর, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে হবে। জন্মের পর শিশুর স্স্থু বিকাশ অর্থাৎ মা-বাবার আদর যতœ পাওয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, উপয্ক্তু পরিবেশে লেখাপড়া ও খেলাধুলার নিশ্চয়তা থাকলে তার মাঝে সাধারণত আইডি’র প্রভাব থাকবে না। কিন্তু যদি এসবের ঘাটতি থাকে, যেমন শৈশবে মা-বাবা হারানো, পুষ্টি ও খাদ্য ঘাটতি, পরিবার ও সমাজের নিষ্ঠুরতার শিকার হলে তার মাঝে আইডির প্রভাব থাকবে। ওই মানুষ যখন বড় হয়ে উঠবে, তখন তার পক্ষে যে কোন নিষ্ঠুরতা ও পশুবৃত্তি দেখা দিতে পারে।
×