ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দোলনের পথ ছেড়ে সমঝোতার দিকে হাঁটছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

আন্দোলনের পথ ছেড়ে সমঝোতার দিকে হাঁটছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চায় বিএনপি। সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা, দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক মামলা থেকে রেহাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা করে ঘুরে দাঁড়াতে চায় দলটি। এজন্য সরকারকে পুরো পাঁচ বছর মেয়াদপূর্তি ও কঠোর আন্দোলনে না যাওয়াসহ বিভিন্ন শর্ত মানতে রাজি বিএনপি হাইকমান্ড। সূত্রমতে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কৌশল হিসেবেই বিএনপি এখন রাজপথের আন্দোলনের দিকে না গিয়ে সংলাপের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একদিকে ভেতরে ভেতরে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা এবং অন্যদিকে কূটনীতিকদের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে পরপর দুবার নির্বাচন বর্জন করা যাবে না। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হোক আর যে সরকারের অধীনেই হোক বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। আর এজন্যই বর্তমান সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের নিশ্চয়তা চায় বিএনপি। উল্লেখ্য, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কথা মাথায় রেখেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ১৮ নবেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ও পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে ১৩ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতারও ইঙ্গিত দেন। পরে ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকালেও তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব দেন এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা কামনা করেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠনের পর বিএনপি এ সরকারের বিরুদ্ধে চরম নেতিবাচক অবস্থান নেয়। কোন অবস্থাতেই এ সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে না বলেও প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দেয়া হয়। আর সরকার পতনের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী টানা ৯২ দিন অবরোধ-হরতাল পালন করে। এ আন্দোলন চলাকালে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা-ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। কয়েক হাজার যানবাহন অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করে বিনষ্ট করা হয়। তাই এ আন্দোলনের পর বিএনপি সম্পর্কে দেশ-বিদেশে চরম নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এদিকে টানা ৯২ দিনের নেতিবাচক আন্দোলন শেষে সরকারও বিএনপির প্রতি কঠোর অবস্থান নেয়। এরপর থেকে বিএনপিকে আন্দোলন দূরে থাক, রাজপথে স্বাভাবিক কর্মসূচী পালন করতে গিয়েও সরকারের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর এ কারণেই এবার সরকারের তিন বছরপূর্তিতে রাজপথে কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দিয়েও করতে পারেনি বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি আরও ভালভাবে বুঝতে পারে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে আর এগিয়ে যাওয়া সম্বব নয়। আর এ কারণেই এখন পুরনো কৌশল বদল করে সমঝোতার জন্য নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানাতে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপির এ আহ্বানের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে রাজনেতিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। বান কি মুন নিজে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জর্জ ফার্নান্দেজ তারানকোও একাধিকবার ঢাকায় এসে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে দুই দলের নেতাদের একসঙ্গে বসিয়ে একাধিক বৈঠকও করেন তারানকো। কিন্তু দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক টেবিলে বসাতে না পারায় জাতিসংঘের উদ্যোগ সফল হয়নি। নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে সারাদেশে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যখন সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছিলেন তখন একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন। সেই সঙ্গে তিনি খালেদা জিয়াকে গণভবনে চায়ের আমন্ত্রণও জানান। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হওয়া ও গণভবনে না যাওয়ায় দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ হয়নি। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দফায় দফায় নতুন সরকারের কাছে সংলাপের আহ্বান জানাতে থাকেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা। কিন্তু যখনই বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা তা নাকচ করে দিয়েছেন। সূত্রমতে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার জন্য বিএনপি এ সরকারকে পুরো পাঁচ বছর মেয়াদপূর্তি ও কঠোর আন্দোলনে না যাওয়াসহ বিভিন্ন শর্ত মানতে রাজি। বিনিময়ে সকল দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা এবং দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক মামলা থেকে রেহাইসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা চায় দলটি। এজন্য বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় রয়েছে। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। তবে জামায়াতের কারণেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আজ বেকায়দায় পড়েছে মনে করে দলের একটি অংশ আপাতত জামায়াতকে এড়িয়ে চলার দাবি জানালেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না। তবে কৌশলে প্রকাশ্যে জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখলেও ভেতরে ভেতরে সুসম্পর্ক রাখছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটগতভাবেই করতে চায় বলেই বিএনপি এ কৌশল নিয়েছে। সূত্রমতে, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে কিভাবে সরকারকে সমঝোতায় এনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা যায় তা নিয়েই বিএনপি হাইকমান্ডের এখন যত চিন্তা। একদিকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও অপরদিকে দলের সর্বস্তরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি পুনর্গঠন করার চেষ্টাও চালাচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় কাউন্সিলের পর ৫৯২ সদস্যের ঢাউস কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর সম্প্রতি কয়েকটি জেলা কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল ও জাসাসের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপ ও সমঝোতার প্রস্তাব অব্যাহত থাকলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা এখন আমলে নেয়া হচ্ছে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা বারবারই উচ্চারণ করছেন অবিলম্বে সংলাপ করে পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতা করার। বিদেশী কূটনীতিকরাও ধারাবাহিকভাবে এ কথা বলে আসছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড তা আমলে নিচ্ছেন না। বরং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতারা প্রতিনিয়তই বলছেন, যারা আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের সঙ্গে কীসের সংলাপ-সমঝোতা? শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করায় রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ। আশা করছি তিনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন। রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের হতে পারেন। অনেকেই সন্দেহ করেন আওয়ামী লীগ যা বলবে তিনি তাই করবেন। এটা চিন্তা করার কোন দরকার নেই। এ সংলাপের ধারাবাহিকতায় শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার পর তিনি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়েও উদ্যোগ অব্যাহত রাখবেন, যাতে আমরা আরও সংলাপে যেতে পারি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। তবে এর জন্য প্রয়োজন সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকালে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ-সুষ্ঠু হয় এজন্য বর্তমান সরকারের সঙ্গে সংলাপ করে সমঝোতা করতে চাই। আমরা চাই সরকার বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে একটি সমঝোতা করুক। আর তাহলে দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। এতে দেশের সকল রাজনৈতিক দলই উপকৃত হবে।
×