ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান নীরব

একের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে বগুড়ার ওয়াক্ফ এস্টেট

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

একের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে বগুড়ার ওয়াক্ফ এস্টেট

সমুদ্র হক ॥ বৃহত্তর বগুড়ার ওয়াক্ফ এস্টেটগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ দখলকারীই ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি। এর বাইরেও এক শ্রেণীর ভূমিগ্রাসী চক্র ওয়াক্ফ সম্পত্তিগুলো জোর করে দখলে নিচ্ছে। প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীও ওয়াক্ফ সম্পত্তি বেআইনীভাবে কম দামে কিনে নিচ্ছে। সরকারকে ফাঁকি দিচ্ছে বিপুল রাজস্ব। এসব অনিয়মের কোন প্রতিকার নেই, সরকারের দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানও নীরব। বগুড়া ও জয়পুরহাটে (বৃহত্তর বগুড়া) ওয়াক্ফ এস্টেটের পরিমাণ এক হাজার ১৮৮টি, জমির পরিমাণ অন্তত ৪২ হাজার একর। এর মধ্যে প্রজাবিলি জমির পরিমাণ ৩৫ হাজার একর। প্রজাবিলি অর্থ ওয়াক্ফকারী যে জমি তাদের ওয়ারিশদের বর্গা দিয়েছেন বা দান করেছেন। বাকি সাত হাজার একর জমি ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে রাখা হয়। এই জমিরও দুই হাজার একরেরও বেশি বেদখল হয়ে গেছে। ওয়াক্ফ সম্পত্তির সরকারীভাবে প্রদেয় রাজস্ব অংশের অন্তত ৫০ লাখ টাকা পাওনা পড়ে আছে। কর্তৃপক্ষের কথা, লোকবলের অভাবে তদারকি করা যায় না। যেটুকু তদারকি হয়েছে সেখানে অনিয়ম পাওয়ার পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকারী নিয়ম উপেক্ষা করে বেচাকেনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোন সদুত্তর নেই। এই ধরনের বেচাকেনায় কোন মামলা হয়েছে কিনা এই বিষয়ে কোন উত্তর মেলেনি। দেশের সব ওয়াক্ফ সম্পত্তি দেখভাল করে সরকারের ওয়াক্ফ প্রশাসন। মাঠপর্যায়ে একজন পরিদর্শকের অধীনে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে চলছে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম। বগুড়া ও জয়পুরহাটের ওয়াক্ফ ভূমি দেখাশোনা করেন একজন পরিদর্শক। সূত্র জানায়, ভূমিগ্রাসী চক্রের সঙ্গে ওয়াক্ফ প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মচারীর সখ্য রয়েছে। তারাই বলে দেয় কিভাবে কোন ফাঁকফোকর গলিয়ে ওয়াক্ফ সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া যায়। বগুড়া সদরের এরুলিয়া এলাকায় পীর আজিজুল্লাহ (র.) মাজার ওয়াক্ফ এস্টেটের তিনটি পুকুরসহ প্রায় ১৭ বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। দুপচাঁচিয়া হিরঞ্জা এলাকার দমশের তালুকদার ওয়াক্ফ এস্টেটের ৬৩ একর ভূমির মধ্যে প্রায় ২৬ একর জমি দখল হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, যাদের কাছে সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তারাই দখল করেছে। এই এস্টেটে সরকারী অংশের প্রদেয় রাজস্ব বকেয়া রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই এস্টেটের মোতাওয়াল্লিকে বাতিল করে সরকারের প্রতিনিধি (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) দায়িত্ব পেয়েছেন। গাবতলীর গোড়াদহ এলাকায় ছমির উদ্দিন সরকার ওয়াক্ফ এস্টেটের ৬১ একর সম্পত্তির মধ্যে প্রায় ৪৫ একর বেদখল হয়ে গেছে। এই এস্টেটেও দখলের অভিযোগের আঙুল মোতাওয়াল্লির দিকেই। বগুড়া শহরে বৃন্দাবনপাড়ায় মুন্সি নাসির উদ্দিন ম-ল ওয়াক্ফ এস্টেটের অর্ধেক ভূমি দখল হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে বগুড়ার নওয়াব এস্টেটের ওয়াক্ফ ভূমি ও স্থাপনা। এই এস্টেট তদানীন্তন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পূর্বপুরুষের। বংশানুক্রমে তাদের পরিবারের সদস্য মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। নিকট অতীতের পূর্বপুরুষ সোবাহান চৌধুরী তার স্ত্রী তহুরুন্নেছা থেকে পরবর্তী বংশধরেরা জমিদারি ও নওয়াবী খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভোগ দখল করতে থাকেন। চতুর্থ বংশের মোহাম্মদ আলী বগুড়া। তার আগের বংশধর বেশ কিছু জমি শিক্ষা ও মানব কল্যাণে ওয়াক্ফ করেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়া মারা যাওয়ার পর বৈমাত্রেয় ভাই ওমর আলী চৌধুরী, আমির আলী চৌধুরীর নজর পরে ওয়াক্ফ সম্পত্তির দিকে। শুরু হয় বেচাকেনার পালা। বৈমাত্রেয় দুই ভাই মারা যাওয়ার পর মোহাম্মদ আলীর তিন ছেলে এক মেয়ে দায়িত্ব পান মোতাওয়াল্লির। ওয়াক্ফ এস্টেট বেচাকেনার পালার পর তাদের বসতভিটার অংশ বেচাকেনা শুরু হয়। বসতভিটার ধারে যে বিশাল ভূমি ওয়াক্ফ করা আছে তার সবই নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিক্রি হয়েছে। দুজন বিড়ি ব্যবসায়ী, একটি বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, ঢাকার বড় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ওয়াক্ফ ভূমি কিনে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে। সর্বশেষ এক বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ শতাংশ ওয়াক্ফ ভূমি কেনেন। জনশ্রুতি আছে, এই ভূমির দাম অন্তত ৫০ কোটি টাকা। এর দশগুণ কম দামে দলিল হয়েছে। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে বহু অঙ্কের টাকা। মোহাম্মদ আলী বগুড়ার তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে তাদের বসতভিটার যে অংশটুকু এখনও টিকে আছে তা রক্ষায় সরকারকে অধিগ্রহণের আবেদন জানিয়েছিলেন। এক শ’ বছরের প্রাচীন স্থাপনা হওয়ায় এই অবকাঠামো প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। প্রতœ অধিদফতর নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরও একটি প্রভাবশালী চক্র বেচাকেনার হাল ছাড়েনি। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর মুকিমপুর এলাকার চৌধুরী ওয়াক্ফ এস্টেটের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি দখল হয়ে গেছে। ভূমিদস্যুরা যেখানেই ওয়াক্ফ সম্পত্তির খোঁজ পাচ্ছে, সেখানেই গ্রাসের জন্য সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
×