ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন পাঠ্যবইয়ের ভুল অমার্জনীয়, স্বীকার করলেন শিক্ষামন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

নতুন পাঠ্যবইয়ের ভুল অমার্জনীয়, স্বীকার করলেন শিক্ষামন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া নতুন পাঠ্যবইয়ে অমার্জনীয় ‘ভুলভ্রান্তি’ স্বীকার করে ঘটনায় জড়িত সকলকে শাস্তির আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দায়ী কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘বড় বড় ভুল যেমন- কাভার পেজে বড় অক্ষরে ছাপার শব্দে ভুল, কবিতা বিকৃতি। যাদের জন্য এ বড় ভুল তাদের কেউ রেহাই পাওয়ার যোগ্য নয়। ভুল কিভাবে সংশোধন করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনের আলোকে দুজনকে ওএসডি করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে জড়িত সবাইকে পরিপূর্ণ শাস্তি দেয়া হবে।’ চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কয়েকটি বইয়ের ভুলত্রুটি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন, অতিরিক্ত সচিব অরুণা বিশ্বাস, চৌধুরী মুফাদ আহমদ ও রুহী রহমান, মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী প্রমুখ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ভুলত্রুটি আর ব্যর্থতা আছে। যাই হোক, বছরের প্রথম দিন বই বিতরণ একটি বিশাল ‘কর্মযজ্ঞ’। তবে আমি এ রকম (ভুল) আশা করিনি। এখানে পরিপূর্ণ সকল বিষয়ে আলাপ করব না, সেটা সম্ভবও নয়। আপনারা সকল বিষয়ে (সাংবাদিক) প্রশ্ন না করলেই খুশি হব। অনেক ভুলত্রুটি হয়েছে, সীমাবদ্ধতা আছে, ত্রুটি থাকতেই পারে। ভুলগুলো শিক্ষক ঠিক করে দেবেন, যারা দায়ী তারা ঠিক করে দেবেন। এগুলো না করে যদি ঠিক উল্টোটা করতে থাকি, তাহলে ছেলেমেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি বা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি, ভুলের জন্য আমাদের বিচার হওয়া উচিত, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের সকলের। যেটা তাদের ওপর নেগেটিভ প্রভাব ফেলে আমি মনে করি সেটা করা উচিত নয়। সবগুলো ভুলই সংশোধনযোগ্য বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেন, কিছু ভুল থাকতে পারে ছাপার ভুল, যেগুলো সংশোধনী দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। কিছু ভুল থাকতে পারে বড় ধরনের, যেটা সংশোধন করতে গেলে ওই জায়গাটা ‘রিপ্লেস’ করতে পারি। কিছু ভুল থাকতে পারে যেগুলো থাকা উচিত ছিল না, সেগুলো ‘অমিট’ করার জন্য সরকারের নির্দেশ পাঠিয়ে দেব, ওই পাতাগুলো আমরা ছিঁড়ে নেব বা ‘ব্লক’ করে দেব- এভাবে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। সব ভুলই সংশোধনযোগ্য। কিন্তু সবাইকে আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি, যারা এ ভুল করেছেন তারা রেহাই পাওয়ার যোগ্য নন। আগেই তাদের ওএসডি করেছি, তদন্ত করে আরও কারা কারা আছেন, কার ভুল, কে কতটুকু দায়ী- সে অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক স্তরের বইয়ের ভুল ও বিকৃতির দায় এনসিটিবি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপালেও সংবাদ সম্মেলনে তিন প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি সম্পর্কে জানালেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের দায় স্বীকার করে বলেছেন, শুধু বই ছাপানো, বাঁধাই ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করে থাকে এনসিটিবি। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের পা-ুলিপি প্রণয়ন, সম্পাদনা, পরিমার্জন ও অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই ভাবে মাধ্যমিক স্তরের পা-ুলিপি প্রণয়ন, সম্পাদনা, পরিমার্জন ও অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি আংশিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কিছু শর্তের কারণে প্রাথমিকের বই ছাপাখানায় পাঠাতে দেরি হয়েছে। অল্প সময়ে অতি দ্রুত বইগুলো সম্পাদনার কাজটি শেষ করা হয়েছে। এর ফলে মুদ্রণের জন্য খুব সীমিত সময় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে কিছু ভুলত্রুটি সত্ত্বেও সকল শিক্ষার্থীর কাছে বছরের শুরুর দিনে বই পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ছাগলের যে ছবি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে তা ‘দেখা হবে’ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ছাগল গাছে উঠে আম খাচ্ছে ফটোশপে তৈরি এমন কিছু ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। ওই ছবি পত্রিকায় ছাপা ঠিক হয়েছে কিনা- সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বাঁকা আমগাছের গোড়ার ছাগলকে কারসাজির মাধ্যমে গাছের মগডালে তুলে দেয়া হয়েছে। আর ওই ছবি দিয়ে অনলাইনে ফেসবুকের মাধ্যমে অপপ্রচার চালানোর প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বই’-এ সাত পাতায় ছাগলের গাছের গোড়ার ছবিটি মগডালে তুলে দিয়ে অপপ্রচার চালানোর ছবি দেখান। সাদা এক পৃষ্ঠায় একটি রঙ্গিন ছবি দেখিয়ে তিনি জানান, একটি ছবি এঁকে সমস্ত জায়গায় প্রচার করা হচ্ছে। ফেসবুক-ইউটিউবে যাচ্ছে। জনগণের ধারণায় নিয়ে আসা হয়েছে যে, ছাগল গাছের মগডালে উঠে আম খাচ্ছে। এ ধরনের কোনো পৃষ্ঠা কোন বইয়ের মধ্যে নেই, অথচ এটা প্রচার করা হচ্ছে। এটাকে লিঙ্ক করা হয়েছে, প্রথম শ্রেণরি ‘আমার বই’-এর সঙ্গে। এরপর বলেন, ছাগল গাছের দিকে তাকিয়ে আম খুঁজছে নাকি আম খাওয়ার আক্ষেপ করছে সেটি তদন্ত করে দেখার বিষয়। তবে শিশুদের বইয়ে এ রকম ছবি দেয়াকে তিনি গুরুতর অপরাধের মধ্যে নেয়ার পক্ষে নন। ছাগল গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কেন তাকিয়ে আছে বা কেন এ ছবি দেয়া হলো সেটি বুঝতে হবে। এটা বোঝার বিষয়। তবে বাংলা পাঠ্যবইয়ে ছবিটি দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি ছোটদের বই। এখানে অনেককিছুই দেয়া হতে পারে। তবে কেন ছাগলকে নির্বাচন করা হলো সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে মন্ত্রী বলেন, এটা কি মজা দেয়ার জন্য দেয়া হয়েছে নাকি বিভ্রান্ত সৃষ্টির জন্য এ ছবি নির্বাচন করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। উল্লেখ্য, প্রথম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবই ‘আমার বই’-এর সাত নম্বর পাতায় দেখা যায়, অ-তে অজ লিখে ছাগলকে গাছে চড়িয়ে দিয়ে আম খাওয়ানোর চেষ্টা করানো হচ্ছে। এ ছবি নিয়ে সারাদেশে বিতর্ক চলছে। ‘ও-তে ওড়না’ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নানা মত থাকতে পারে, আমরা সবগুলো মতামত ওয়েলকাম করি। কিছু ভুল পেয়েছি, যা হওয়া উচিত নয়। হার্ট বানানে ভুলের বিষয়ে নাহিদ বলেন, যিনি সম্পাদনা করেছেন তার এটা দেখা উচিত ছিল, এ বিষয়টিকে আমরা ক্ষমা করতে পারি না। শব্দ ও বানান ভুল হতেই পারে, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আদর্শ ছেলে কবিতায় যে ভুল হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ২০১২ সালে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়নের পর হেফাজতে ইসলামের ১৭ দফা দাবি অনুযায়ী বইয়ের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এখানে কারও আন্দোলনকে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ নেই, আমরা সবার মতামত নিয়েছি। এনসিটিবির আরও এক কর্মকর্তা বরখাস্ত ॥ শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া নতুন পাঠ্যবইয়ে ভুলত্রুটির ঘটনায় এনসিটিবির আরও এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এনসিটিবির আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদিনকে মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী জানিয়েছেন, এনসিটিবি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের ভুল পর্যালোচনা করতে গত ৫ জানুয়ারি এনসিটিবির সদস্য (অর্থ) কাজী আবুল কালামকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় সংস্থাটি। ওই কমিটির প্রাথমিক তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার ও উর্ধতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে ওএসডি করা হয়।
×