ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্লাস্টিক কন্টেনারে বিষ!

উপকারী মনে করে ঘরে তোলা, মৃত্যুর সঙ্গে পথচলা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

উপকারী মনে করে ঘরে তোলা, মৃত্যুর সঙ্গে পথচলা

সমুদ্র হক ॥ জেনে শুনে বিষ পান করার মতোই অবস্থা। যাকে উপকারী মনে করে পথ থেকে তুলে এনে ঠাঁই দেয়া হয় ঘরে, পরবর্তীতে সে-ই রূপ নেয় বিভীষণের। দিনে দিনে স্লো পয়জনিংয়ের ফাঁদে ফেলে মৃত্যুর সঙ্গে হাত ধরে পথচলা শুরু করে। এই জড় বস্তুটি আপনার ঘরের কোন এক কোনায় আছে। যার মধ্যে রেখে দিয়েছেন চাল ডাল মুড়ি খই শুকনো খাবার। কেউ রাখে খাবার পানি। এই জিনিসটির নাম প্লাস্টিকের কন্টেনার ও জ্যারিকেন। নীল হলুদ সাদা নানা রঙের হয়, যা আসে মৃত্যুদূত হয়ে। নগরে শহরে গ্রামে স্র্রোতের মতো পৌঁছে যাচ্ছে এই কন্টেনার। পয়সা খরচ করে কন্টেনার জ্যারিকেনের সঙ্গে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিষাক্ত রাসায়নিক। খোঁজ করে দেখা হয় না কোথা থেকে আসছে এই পাত্র। কী আছে এর মধ্যে, যা বেঁচে খালি করে খোলসটি বিক্রি করা হচ্ছে। উচ্চবিত্তরা তো এগুলো কিনছেই, দামে সস্তা হওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের ঘরে বড় আসন করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগের বাড়িতে এখন আর মাটির বড় পাতিল, বাঁশের ডোল ও চাঙ্গারি, টিনের ড্রামে ধান চাল ডাল ও অন্যান্য পণ্য রাখে না। শক্ত টেকসই, সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় এবং ঘরের কথিত সৌন্দর্য বাড়াতে প্লাস্টিকের কন্টেনার কিনে নিয়ে যায়। কী আছে এই কন্টেনারে! খোঁজ খবর করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব তথ্য- যা ভীতিকর। শুনলে গা শিউরে ওঠে। অধিকাংশ কন্টেনারে আছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। এ ছাড়াও ফ্যাক্টরি কল-কারখানায় উৎপাদনের জন্য কন্টেনারে ভরে কাঁচামাল হিসেবে আসে অনেক রাসায়নিক যৌগ। ব্যবহারের পর খোলস হিসাবে বাজারে পাওয়া যায় সেই কন্টেনার। কিনে নিয়ে যায় সাধারণ মানুষ। ব্যবহার হয় ঘর গেরস্থালিতে। ধারণক্ষমতা ও আকারভেদে কন্টেনারের দাম ২শ’ টাকা থেকে ১২শ’ টাকা। দোকানিরা বলেন, সাবান সোডা দিয়ে পরিষ্কার করার পর তা বিক্রি উপযোগী (সত্যিই কি) করা হয়। কন্টেনার আসে বিদেশ থেকে। ক্রেতারা প্লাস্টিকের কন্টেনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আরেক দফা বা কয়েক দফা গরম পানিতে গুঁড়ো সাবান সোডা মেখে পরিষ্কার করে রোদে শুকায়, তারপর ব্যবহার। এই পর্যন্ত শেষ হলেই ভাল হতো, তবে তা হয় না। কারণ কন্টেনারে যা আসে তা এতটাই বিষাক্ত যে ধুলেও রেশ থেকে যায়। টক্সিকগুলোর মধ্যে আছে- পারদ, সীসা, দস্তা, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি। অনেক দ্রাবক হিসেবে থাকে। রবার ও প্লাস্টিক শিল্পের প্রধান উপাদান এ্যানোমেটিক নামের রাসায়নিক দ্রব্য আসে কন্টেনারে। এর মধ্যে থাকে এ্যামাইন ও এ্যামিলিন। কন্টেনারে লেগে থাকা এ সব রাসায়নিক গরম পানিতেও গলে না। অনেক সময় কোনায় কামড়ে থাকে রাসায়নিক যৌগ। যা ধোয়ার পরও রয়ে যায়। টেরও পাওয়া যায় না। কিছু যৌগ থাকে তেলতেলে। যা সহজে ছাড়ানো যায় না। বিশেষ করে রঙের কন্টেনার পরিষ্কারের পরও তার মধ্যে প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে রয়ে যায়। যা ধীরে ধীরে রাখা কোন পণ্যের সঙ্গে মিশে স্লো পয়জনিংয়ের কাজ করে। বলাবলি হয় আগুনের তাপে খাবার সিদ্ধ করলে বিষাক্ততা দূর হয়। এই কথা সকল ক্ষেত্রে ঠিক নাও হতে পারে। যে খাদ্যশস্য দিনের পর দিন কন্টেনারে রাখা হয় তা ধীরে ধীরে বিষের সংমিশ্রণে আসে। এই বিষ নানাভাবে মানবদেহে ঢুকে পড়ে। যার থেকে চর্মরোগ থেকে ক্যান্সার ও ভয়াবহ জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। বিষাক্ত রাসায়নিক ক্রিয়া শুরু করে দু’ভাবে- প্রাইমারি ইরিট্যান্স ও সেনসিডাইজং সাবস্ট্যান্সে। প্রথমটি চামড়ার ওপরেই দৃশ্যমান। পরেরটি ত্বকের ভিতর দিয়ে রক্তে গিয়ে পৌঁছে। কোন যৌগ রক্তে গিয়ে লোহিত কনিকা অকেজো করে দেয়। সেখান থেকে চলে যায় যকৃত কিডনিতে। ফলে হজমের জন্য যেসব এনজাইম বের হয় লিভার থেকে সেই প্রক্রিয়াকে অকেজো করে দেয়। এর প্রভাবে আক্রান্ত হয় মূত্রনালী, ফুসফুস, হার্ট, মস্তিস্ক, লিভার কিডনি। নানা ধনের জটিল ব্যাধি বাসা বাঁধে। যা সহজে ধরা পড়ে না। প্রাথমিক অবস্থায় লুকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ বড় হয়ে দেখা দেয়। লিউকোমিয়ার (ব্লাড ক্যান্সার) অন্যতম কারণ রক্তে সলভেন্ট জাতীয় রাসায়নিকের অনুপ্রবেশ। এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, বিষক্রিয়াগুলোর প্রভাব শরীরে এমনভাবে পড়ে যা থেকে মনে হতে পারে অন্য ব্যাধি। আসলে গভীরের পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে প্রকৃত রোগ। যেমন তীব্র ও অনবরত মাথা ব্যথা হলে মনে করা হয় সাইনোসাইটিস। হাঁড়ের জোড়ায় ব্যথা হলে মনে করা হয় গাঁট বা বাত জাতীয় কিছু। ক্ষুধা না লাগা, অরুচি, ঘনঘন পেটের ব্যথা, খিঁচুনি, দুর্বলতা কোষ্ঠকাঠিন্য হলে সাধারন রোগের উপসর্গ মনে করা হয়। উপসর্গ যাই হোক তা খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই। কন্টেনারের রাসায়নিক যৌগ থেকে কোন রোগ উৎপত্তি হচ্ছে কিনা এই বিষয়ে চিকিৎসকগণ বলেন, কোথা থেকে কোন রোগের উৎপত্তি হচ্ছে তা বলা সহজ নয়। তবে কন্টেনারের ভিতরের কোন রাসায়নিক যৌগ থেকে বড় ধরনের রোগব্যাধি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। দেশের প্রতিটি স্থানে এইসব কন্টেনার বিক্রি হচ্ছে। কোন্ কন্টেনারে কী ধরনের কেমিক্যাল ছিল তা লেখা থাকে। এ থেকে বোঝা যায় কত মাত্রার বিষাক্ত কেমিক্যাল ছিল। অনেক কন্টেনারে বিদঘুটে গন্ধ লেগেই থাকে। তারপরও ক্রেতারা জেনে শুনে তা কিনে নিয়ে যায়। এভাবে বিষাক্ত রাসায়নিক বিক্রি হয় অথচ স্বাস্থ্য বিভাগের কোন মাথাব্যথা নেই। তারা জানেও না কিভাবে কন্টেনার বিক্রি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কোন জরিপও নেই। কোন বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে গবেষণা করেছে তাও জানা যায়নি। একজন অধ্যাপক বলেন, বিষয়টি নিয়ে যে গবেষণা হয় তা মূলত একাডেমিক। যে কারণে তথ্য প্রচারিত হয় না। কালেভদ্রে প্রচারে যা আসে তাও বিচ্ছিন্নভাবে। কেউ গা করে না। জেনে শুনে বিষ কিনে নিয়ে পান করছে সাধারণ মানুষ।
×