ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত বিচারেও জট

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

দ্রুত বিচারেও জট

বিকাশ দত্ত ॥ সময়মতো সাক্ষী না আসায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনে করা মামলার বিচার ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। ফলে সারা দেশে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিচার না হওয়াতে হাজার হাজার বিচারপ্রার্থী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। আবার বিনা বিচারে কারাবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন বহু আসামি। বর্তমানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলোতে তিন হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অন্যদিকে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দেড় লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারক সঙ্কট ও ট্রাইব্যুনাল কম থাকায় আশানুরূপভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ১৩৫ দিন পার হয়ে গেলেও মামলা চলতে পারে। নতুন করে মামলাটি পাঠিয়ে দিলে পুনরায় আবার ১৩৫ দিনের মধ্যেই শেষ করতে হবে। উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করা। আমরা চেষ্টা করব যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিধানই তো আছে। নির্দিষ্ট সময় শেষ না হলে মামলাটি পাঠিয়ে দেয়া হবে। তবে বলা হয়নি, কেন দেরি হলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নিম্নœ আদালতের বিচারকদের দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির কলাকৌশল শিখিয়ে থাকি। আমরা সব সময় চাই, মানুষের যেন দুর্ভোগ না হয়, সেদিকে বিচারকরা যতœশীল হোক। তাই দ্রুত বিচার আইনে ১৩৫ দিনের মধ্যে মামলা শেষ করতে বিচারকদের আমরা অনুরোধ করি। যদি শেষ না হয়, তাহলে ট্রাইব্যুনালের আগে যে আদালতে মামলাটি ছিল, সেই আদালতে ফেরত পাঠাতে হবে। ফেরত পাঠানোর পর রাষ্ট্রপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। মামলার জট ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছেÑ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের মূল সমস্যা বের করে সমাধান করতে হবে। তা না হলে যেখানে আছি সেখানেই থেকে যাব। নতুন নতুন বিচারক নিয়োগ করে কোনভাবেই সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আইনজীবীদের অভিমত, পদ্ধতিগত কারণে মামলায় দীর্ঘ জট যুক্ত হচ্ছে। সনাতনী পদ্ধতিগত কারণে মামলা জট বেড়ে যাচ্ছে। অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষদের মধ্যে নোটিস জারি হয় বছরের বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হওয়ায় পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিস জারি হয়ে ফেরৎ আসায় পরে ভুল নথিতে এসব বিষয় উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। এ কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত হতেই বিলম্বিত হয়। উল্লেখ্য, রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় করা হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ অন্যান্য আসামির মামলাটিও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়াতে দায়রা আদালতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিল এই জঙ্গি সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়, পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা হলেও বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন। বার বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, তাগিদ দেয়ার পরও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসা ইত্যাদি কারণে মামলার বিচার শুরু হতে বিলম্ব হয়। ঘটনার প্রায় আট বছর পর দুই মামলায় ১৪ জনকে আসামি করে ২০০৮ সালের ৩০ নবেম্বর ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথকভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এ এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানো হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, ১৩৫ কার্যদিবসে বিচার শেষ না হওয়ায় হত্যা মামলা দায়রা আদালতে ফেরত যায়। ফলে হত্যা মামলাটি আবার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে স্থানান্তর হয়। নির্দিষ্ট সময়ে বিচার না হওয়াতে এতে হাজার হাজার বিচারপ্রার্থী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। আবার বিনা বিচারে কারাবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন বহু আসামি। যদিও দ্রুত বিচারের ওই সব মামলায় কত আসামি কারাগারে বন্দী, তার সঠিক কোন তথ্য নেই। কতজন আসামি বিচার শেষ হওয়ার আগে জামিনে বেরিয়ে গেছেন, তারও তথ্য নেই। ২০০২ সালের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালে মামলা আসার দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এর মধ্যে না হলে পরবর্তী ৩০ দিনে শেষ করতে হবে। এতেও যদি বিচার শেষ না হয় তাহলে আরও ১৫ দিন সময় নিতে পারবেন বিচারক। এভাবে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। মূলত সাক্ষী হাজির করতে না পারায় এই সময়ের মধ্যে মামলা শেষ হচ্ছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফৌজদারি কৌঁসুলিরা বলছেন, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের একটি নির্দেশনার কারণে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না। আবার দ্রুত বিচার মামলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ সালের ৩ জুলাই আপীল বিভাগ এসএম মোজাম্মেল হক তালুকদার বনাম রাষ্ট্র মামলার রায়ে ১৩৫ কার্যদিবসের বাধ্যবাধকতা বাতিল করেন। এতে বলা হয়, ১৩৫ দিনের সময়সীমা বাধ্যবাধকতা নয়, নির্দেশনামূলক। তাই ট্রাইব্যুনাল ১৩৫ দিনের পরেও বিচার চালিয়ে নিতে পারেন। ফলে বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন। মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ময়মনসিংহ শহরে খুন হন কাঁচামাল ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ। ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলায় হলেও মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ আসে। এ ট্রাইব্যুনালে ৭৮ জনের মধ্যে ২৬ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সম্প্রতি এক আসামি জামিন নিতে এলে হাইকোর্ট এই মামলার বিচার ২৬ বছরে শেষ না হওয়ার কারণ জানতে চান। জবাবে ওই ট্রাইব্যুনালের বিচারক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি এ্যাটর্নি জোনারেল শেখ একেএম মনিরুজ্জামান কবির বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলা শেষ না হওয়ায় দাগি আসামিরা হাইকোর্টে জামিন নিতে আসেন। হাইকোর্টও জামিন দেন তাদের। এজন্য দাগি আসামিদের বিচার ট্রাইব্যুনালে দ্রুত শেষ করা দরকার। ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৭৬ কেজি বোমায় হত্যার চেষ্টা করা হয়। এতে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরণের দুটি মামলা হয়। ২০০৯ সালে হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলা দুটির বিচার গোপালগঞ্জের আদালতে শুরু হলেও দ্রুত শেষ করতে ২০১০ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়। ৮৯ সাক্ষীর মধ্যে ৬৬ জনের সাক্ষ্য নেয়া হলেও এখনও হত্যা চেষ্টার বিচার শেষ হয়নি। দ্রুত বিচার মামলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে চাঞ্চল্যকর মামলা বাছাইয়ের পর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগী শহরে স্থাপিত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। বর্তমানে ঢাকায় চারটি এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট মহানগরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর এসব ট্রাইব্যুনালে চাঞ্চল্যকর অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত নয়টি ট্রাইব্যুনালে ৩ হাজার ৯৮ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দুই হাজার ৩৭০ মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে এক নম্বর ট্রাইব্যুনালে ১৪৫, দুই নম্বরে ৫৭১, তিন নম্বরে ৮৭০ ও চার নম্বর ট্রাইব্যুনালে ৭৮৪ মামলা রয়েছে। চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২৭, রাজশাহীতে ৮৯, খুলনায় ১৭৩, বরিশালে ৩৫০ ও সিলেটের ট্রাইব্যুনালে ৮৯ মামলা রয়েছে। এদিকে নারী-শিশু মামলায় সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দেড় লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ৫৪ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এক লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৭ মামলার বিচার চলছে। আর যেসব জেলায় ট্রাইব্যুনাল নেই, সেই সব জেলায় জেলা জজ আদালত নারী-শিশুর মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন। এ রকম ১৮ জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে ১৩ হাজার ৯২৬ মামলা। সব মিলিয়ে দেশে বাহাত্তরটি আদালতে এক লাখ ৫২ হাজার ৪২৩ নারী-শিশু নির্যাতনের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
×