ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বলদেব অধিকারীর চিত্রকর্ম

লোক চিত্রকলার সরল পরিভাষায় বাংলার গ্রাম, জীবন সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

লোক চিত্রকলার সরল পরিভাষায় বাংলার গ্রাম, জীবন সংস্কৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ নীরিক্ষার যোগ বটে। কত শত রকমের ভাব ও ভাবনা থেকে কাজ করছেন শিল্পীরা! গ্রাম আঁকছেন। তৃণমূলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলছেন ক্যানভাসে। আয়োজন করা হচ্ছে নিয়মিত প্রদর্শনীর। এর পরও ঠিক এই মুহূর্তে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে ঢুকলে অবাক হতে হয়। এখানে চলছে বলদেব অধিকারীর একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। শহুরে আধুনিক চর্চার কালে শিল্পী রীতিমতো চমকে দেন। পেছনে, আরও পেছনে, ফেলে আসা দিনে নিয়ে যান। হ্যাঁ, সেখানেও গাঁও। তৃণমূলের মানুষের নিত্যদিন। কর্মমূখরতা। জীবন সংস্কৃতি। কিন্তু খুব সরল পরিভাষা। রিকশা পেন্টিংসহ ফোক আর্টের নানা বৈশিষ্ট্য তিনি সচেতনভাবেই ধরে রেখেছেন। দেখে তাই অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। ভেতরে লোক মানসকে জাগিয়ে দেয়ার প্রয়াস নেন শিল্পী। প্রদর্শনীর শিরোনামÑ আবহমান বাংলা। কারণে অকারণে অনেকেই এমন শিরোনাম করে থাকেন বৈকী। বলদেব সেটা করেননি। তার এ্যাক্রেলিক মাধ্যমে আঁকা ছবিতে লোকায়ত জীবনের বহমান ধারা। আর যে কথাটি উল্লেখ করা জরুরী, তিনি গাঁয়ের লোক। নড়াইলে বাড়ি। একই মাটির সন্তান কিংবদন্তি শিল্পী এসএম সুলতান। সুলতানের বিরল সান্নিধ্য লাভ করেছেন বলদেব। শিখেছেন তার কাছ থেকে। শিল্পীর আঁকা ছবি সে কথা বলে। নিজের দেখা চারপাশের জগৎ রং তুলিতে মূর্ত করেছেন তিনি। কখনও রিয়ালিস্টিক ভাবনা দ্বারা তাড়িত। কখনও সখনও কল্পনার রঙে সাজিয়েছেন ক্যানভাস। বলদেবের ছবিতে যে গ্রাম দেখা যায় তা ঠিক আজকের গ্রাম নয়। শহরের দিকে তাকিয়ে থাকা গ্রামকে যেন অস্বীকার করতে চান শিল্পী। তার ক্যানভাসের সব ঘরই তাই কুঁড়ে ঘর। বাড়ির আঙিনা, পেছন থেকে উঁকি দেয়া তাল গাছ খেজুর গাছ, পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, পাল তোলা নৌকোÑ কোন অনুষঙ্গই সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোকে ধারণ করে না। এ যেন শেকড় আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা! শিল্পী গ্রামের মানুষের কর্মমুখর জীবনের ছবি আঁকেন। এ জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ারও প্রযোজন বোধ করেন না। বরং ঘরের ওঠোনে দৃষ্টি দেন। আর তাতেই দৃশ্যমান হয় বিপুল কর্মজজ্ঞ। সবই সরল চিত্রভাষায় ফুটিয়ে তুলেন তিনি। ফসল কেন্দ্রীক যত ব্যস্ততা নিপুণভাবে আঁকেন। বলদেবের ছবিতে পুরুষের হাত ধরাধরি করে থাকেন নারীরা। ফসল ঘরে আসার পর বিভিন্ন ধাপে কাজ করতে দেখা যায় তাদের। প্রতিদিনের রান্না, ঘর গেরস্থালি সব তারা করেন। ক্লান্তিহীন। এইসব কর্মকা-ের ছবি আঁকতে গ্রামীণ অর্থনীতির নানা দিক ফুটিয়ে তুলেন। উঠে আসে লোক সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। শিল্পীর আঁকায় গুরু সুলতানের প্রভাব প্রবল। প্রচুর অবয়ব আঁকেন তিনি। তার আঁকা ছবিতে পুরুষের মাংশল পেশি। নারীরাও সবল। নারীর কোমল রূপটিও ঘুরে ফিরে আসে। তার অভিসার, বিরহ, সখীগণের আড্ডা, খোঁপা বাঁধা সবই রং তুলিতে বিশিষ্টার্থক হয়ে উঠে। কোন কোন ছবি হঠাৎ দেখে তো থমকে যেতে হয়। সুলতানের নয় তো! উদাহরণ হতে পারে ‘কৃষক সভা’ শিরোনামের ছবিটি। সমকালীন নানা চিন্তা দ্বারাও প্রভাবিত হতে দেখা যায় শিল্পীকে। আজকের জঙ্গীবাদ, ধর্মের নামে মানুষ খুন, সাম্প্রদায়িক হামলার কথা ক্যানভাসে তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। অসাম্প্রদায়িক লোক সংস্কৃতি থেকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান। আবেগী শিল্পী তার ব্যক্তিগত জীবনবোধ ব্যথা বেদনাকেও শিল্পভাষায় প্রকাশ করেন। সব মিলিয়ে উপভোগ্য। রবিবার বিকেলে বিশেষ এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন শিল্পসমালোচক মইনুদ্দিন খালেদ। প্রদর্শনী ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
×