ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ থেকে আইপিও আবেদন শুরু

মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে টাকা তুলছে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৮ জানুয়ারি ২০১৭

মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে টাকা তুলছে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলনে কোম্পানিগুলো মুনাফা ও সম্পদ অতিরঞ্জিত করে দেখানো অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে খুলনা প্রিন্টিং এ্যান্ড প্যাকেজিং, ফার কেমিক্যাল, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ড্রাগন সোয়েটার নামের কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এটি ঘটেছে। একইভাবে আগামী রবিবার থেকে টাকা উত্তোলন করতে যাওয়া শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে কোম্পানির আর্থিক জমা দেয়া তথ্য কণিকায় বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এর মধ্যেই আজ রবিবার থেকে টাকা আইপিও আবেদন শুরু হচ্ছে কোম্পানিটির। এর আগে স্বয়ং নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন আইপিও অনুমোদনে দুর্বলতার কথা একাধিকবার স্বীকার করেছেন। আবারও প্রমাণিত হলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদনের অভিযোগটি। হিসাববিদদের মতে, বিএএস-৩৬ অনুযায়ী যেকোন প্রতিষ্ঠানের ইমপেয়ারম্যান্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো তা না করে সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখায়। এক্ষেত্রে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজও এর ব্যতিক্রম না। কোম্পানিটিও সম্পদ এবং মুনাফা বেশি দেখিয়ে আসছে। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে স্থায়ী সম্পদ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে। কোম্পানিটি ২০১৬ সালের এপ্রিল-জুনে ৬ লাখ টাকার মোটর যানবাহন বিক্রি করেছে। যে মোটর যানবাহন ৮.১৪ লাখ টাকা হিসাবে সম্পদ দেখিয়ে আসছিল। অর্থাৎ সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছিল। এসব সম্পদের ক্ষেত্রে ইমপেয়ারমেন্ট লস দেখাতে হয়। যাতে ব্যয় বেড়ে মুনাফা কম হয়। একইসঙ্গে সম্পদের প্রকৃত চিত্র থাকে। কিন্তু তা না করে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখায়। এই কোম্পানিই আবার বলেছে, ইমপেয়ারমেন্ট লস হয়নি। বিএসইসি’র সাবেক অফিস অব দ্য চীফ এ্যাকাউন্টেন্ট, কনসালটেন্ট মোঃ মনোয়ার হোসেন (এফসিএমএ, সিপিএ, এফসিএ, এসিএ) বলেন, এ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অবশ্যই ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের উপর অবচয় চার্জ করতে হবে। অন্যথায় মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখানো হবে। যা বিনিয়োগকারীদের মাঝে ভুল তথ্য প্রদান করা হবে। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের সাবেক হেড অব ইন্টারনাল অডিট সামসুর রহমান (এফসিএমএ) বলেন, প্রাচীর, ফ্যাক্টরির ভিতরে রাস্তা, পার্কিং প্লেস, বাগান ইত্যাদি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্পদ। এসব সম্পদ কখানো ভবনের সাথে যুক্ত হতে পারে না। এ সময় তিনি আরও বলেন, ইমপেয়ারমেন্ট লস হওয়ার মতো সম্পদ না থাকলে ৮ লাখ ১৪ হাজার টাকার মোটর যানবাহনে ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা বা ২৬ শতাংশ লোকসান হওয়া তো সম্ভব না। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিগুলো মুনাফা বেশি দেখানোর জন্য ইমপেয়ারমেন্ট লস দেখায় না। দেখা গেছে, ২০১৬ সালের (এপ্রিল-জুন) ব্যবসায় ইপিএস হিসাবে ১.৬০ টাকা ও (এপ্রিল ১৫-মার্চ ২০১৬) ব্যবসায় ৪৩৬.৭০% দেখানো হয়েছে। যদিও ইপিএস যথাক্রমে ০.৪৬ টাকা ও ৪.৩৭ টাকা হয়েছে। যা ২৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফা অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের (এপ্রিল-জুন) সময়ে ৪.৮২ কোটি টাকা মুনাফা বা ০.৪৫ টাকা ইপিএস করেছে। কিন্তু পরবর্তী ৩ মাসে (জুলাই- সেপ্টেম্বর) এ মুনাফা হয়েছে ২.১৯ কোটি বা ০.২১ টাকা ইপিএস। এ হিসাবে মুনাফা কমেছে ৫৪ শতাংশ। কোম্পানির ক্যাশ ফ্লো নাজুক অবস্থা। কোম্পানির ৩ মাসে (এপ্রিল-জুন) অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো হয়েছে ৮৬ লাখ টাকা বা প্রতিটি শেয়ারে ০.০৮ টাকা হয়েছে। এ হিসাবে ১২ মাসে আসে ০.৩২ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির নগদ লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা নাই। কারণ ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিতে গেলেও লাগবে ১ টাকা। ১০৪ কোটি টাকার মূলধনের কোম্পানি চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৮৫ কোটি টাকার শেয়ার ইস্যু করেছে। অর্থাৎ মোট মূলধনের ৮২ শতাংশই এসেছে এ বছর। ৮ মাস পার হয়ে গেলেও যার কোন প্রভাব ব্যবসায় নেই। এরপরেও নতুন শেয়ার ছেড়ে টাকা তুলতে যাচ্ছে কোম্পানিটি। জানা গেছে, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল শেফার্ড ইয়ার্ন লিমিটেডের সাথে একীভূত হয়েছে। এ সময় শেফার্ড ইয়ার্নের শেয়ার প্রতি সম্পদ ছিল ৪৮১.৯১ টাকা ও শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ছিল ১০৬১.৬৯ টাকা। এমতাবস্থায় শেফার্ড ইয়ার্নের একীভূতকরণের পূর্বের ১০ কোটি ২৬ লাখ টাকার শেয়ারই প্রদান করা হয়েছে। যাতে একীভূতকরণের পরে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্র্রিজের শেয়ার প্রতি সম্পদ কমে এসেছে। শ্রমিকদের সাথে নিয়মিত প্রতারণা করছে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। একইসঙ্গে শ্রমিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। কোম্পানি ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনানুযায়ী, নিট আয়ের ৫ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন এবং বিতরণ কোনটাই করছে না। ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চলতি বছরের ৩০ জুন প্রতিটি শেয়ারে সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৮.৭০ টাকায়। তবে এই সম্পদ আইপিও পরবর্তীতে কমে আসবে ১৭ টাকায়। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা ১৮.৭০ টাকা দেখে বিনিয়োগ করলেও মালিকানা পাবে ১৭ টাকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, এখন কোম্পানিগুলো ইস্যু ম্যানেজারদের সহযোগিতায় বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করছে। কোম্পানিতে কিছু না থাকলেও তারা সুন্দর করে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। এমন কোম্পানির আইপিও অনুমোদনে বিএসইসির সতর্ক হওয়া দরকার। এই বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, ইপিএস নিয়ে ছাপাজনিত ভুল হয়েছে। আর আগস্ট ডিসেম্বর মাসে ব্যবসা মন্দা থাকে বলে ক্যাশফ্লো কম হয়েছে।
×