ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারজান, সাদ্দাম নিহত ॥ মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে বন্দুকযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

মারজান, সাদ্দাম নিহত ॥ মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে বন্দুকযুদ্ধ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবশেষে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলায় ১৭ বিদেশী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জনকে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও নেপথ্য কারিগর দুর্ধর্ষ জঙ্গী নেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওসহ ১০ মামলার আসামি সাদ্দাম হোসেন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে জঙ্গীদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল, একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও কিছু বিস্ফোরক। মোটরসাইকেলটির প্রকৃত মালিকের সন্ধান চলছে। যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ ক্যু করার চেষ্টাকারী সাবেক মেজর জিয়াসহ বেশ কয়েকজন দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গী। তারা গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গীর নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম খান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় অভিযান শুরু করে। তারা চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছিল। এ সময় একটি মোটরমাইকেল বেপরোয়া গতিতে চেকপোস্টের দিকে আসতে থাকে। পুলিশ দূর থেকে মোটরসাইকেলটিকে থামার নির্দেশ দেয়। পুলিশ দেখেই মোটরসাইকেলটির দুই আরোহী দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ পিছু নিলে মোটরসাইকেল থেকে গুলি ও তিনটি হ্যান্ডগ্রেনেড ছোড়ে তারা। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে মোটরসাইকেলটি দুই আরোহীসহ পড়ে যায়। দুই আরোহীর একজনের পরনে খয়েরি রঙের গেঞ্জি ও জ্যাকেট এবং অপরজনের গায়ে ছাই রঙের গেঞ্জি ও আকাশি রঙের জ্যাকেট ছিল। খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ তাদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘটনাস্থল থেকে মোটরসাইকেল, একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড তাজা বুলেট ও কিছু বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসকরা দুই মোটরসাইকেল আরোহীকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে পুলিশ ছবি দেখে নিহতদের একজন বহুল আলোচিত নব্য জেএমবির শীর্ষপর্যায়ের নেতা ও গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী নুরুল ইসলাম মারজান (২৩) এবং অপরজন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাদ্দাম (২১) বলে নিশ্চিত হয়। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, মারজান ছিল গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার। সে-ই হলি আর্টিজানকে টার্গেট করেছিল। টার্গেট করার পাশাপাশি নিজেই পাঁচ হামলাকারীকে নির্বাচন এবং তাদের হলি আর্টিজানে হামলার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ২০১৩ সালের শেষদিকে জঙ্গীবাদে জড়ায় মারজান। তার আপন বোন জামাই নব্য জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ সাগরের মাধ্যমে জঙ্গী কর্মকা-ে যোগ দেয়। আগে দুজনই পুরনো জেএমবির একটি অংশের হয়ে কাজ করত। ২০১৫ সালে তারা তামিমের নেতৃত্বে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী বিভাগে পড়াশোনা করলেও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ায় মারজান পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলে। ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে হামলার কয়েকদিন পর কল্যাণপুরের আস্তানায় নব্য জেএমবির নেতারা বৈঠক করে। ওই বৈঠকেই ছোটখাটো হামলার পাশাপাশি বড় হামলার সিদ্ধান্ত হয়। তামিমের নেতৃত্বে মারজানসহ অন্যরা হামলার জায়গা হিসেবে হলি আর্টিজান নির্ধারণ করে। প্রথমে তারা বনানীর একটি রেস্টুরেন্টকে টার্গেট করেছিল। পরবর্তীতে একটি বিদেশী দূতাবাসকেও টার্গেট করেছিল তারা। শেষ পর্যন্ত হলি আর্টিজান বেকারির খোঁজ পাওয়ার পর মারজান সেখানে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত দেয়। মারজানের ওই সিদ্ধান্ত মোতাবেক হামলা চালানো হয়। মারজান আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং আলিম পাস করে। গ্রামের বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামে। পিতার নাম নিজাম উদ্দিন। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার আগে সে স্থানীয় একটি কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে দেয়া এক জবানবন্দীতে আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত তানভীর কাদেরীর ছেলে তাহরীম কাদেরী জানায়, তারা বসুন্ধরার বাসায় ওঠার কয়েকদিন পর তামিম ও মারজান ওই বাসায় যায়। তামিম, চকলেট, মারজানরা বাসায় ব্যাগ নিয়ে যায়। ব্যাগে অস্ত্র ছিল। মারজানও নব্য জেএমবির উচ্চপর্যায়ের নেতা ছিল। তার সঙ্গে সেনাবাহিনীতে ক্যু করার ব্যর্থ পরিকল্পনাকারী পলাতক মেজর জিয়া, নারায়ণগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নব্য জেএমবির প্রধান তামিম আহমেদ চৌধুরী, রাজধানীর রূপনগরে নিহত নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা সাবেক মেজর জাহিদ, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। যুদ্ধাপরাধী ও তাদের গঠিত একটি বিশেষ ইসলামী দলের সঙ্গেও সখ্য ছিল। দলটি নানাভাবে মারজানকে আর্থিকভাবে সহায়তা করত। সূত্র বলছে, গুলশানে হলি আর্টিজানে হত্যাযজ্ঞ চালানো জঙ্গীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল মারজানের। আর্টিজানের ভেতরে নৃশংসভাবে বিদেশী মেহমান ও বাংলাদেশী তিন নারীকে হত্যা করার সময়ও হত্যাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার। হত্যাযজ্ঞের একপর্যায়ে জঙ্গীদের মোবাইলে ‘ধন্যবাদ’ লিখে এসএমএসও পাঠিয়েছিল মারজান। গুলশান হত্যায় মারজান ছিল অপারেশনাল কমান্ডার। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশনা মোতাবেক মারজান হলি আর্টিজানে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়া জঙ্গীদের দিকনির্দেশনা ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, নিহত অপর জঙ্গী মারজানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাদ্দামও দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছিল। সে ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারী গ্রামে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাসহ ১০টি মামলার আসামি ছিল। ওই জাপানী নাগরিককে হত্যার মধ্য দিয়েই বিদেশী হত্যার মিশন শুরুর ঘোষণা দেয় নব্য জেএমবি। ওই হত্যাকা-ের মূল নায়ক ছিল নিহত সাদ্দাম। কুনিও হত্যা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামিও ছিল সে। তার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের শীর্ষ নেতা সাদ্দাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, নিহত সাদ্দাম নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিল। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে নব্য জেএমবি যেসব হত্যাকা- সংঘটিত করেছে, তার বেশিরভাগেরই মূল পরিকল্পনাকারী ছিল সাদ্দাম। সাদ্দাম রাহুল, চঞ্চল, সবুজ ও রবি নামেও পরিচিত ছিল। জাপানী নাগরিক হত্যা মামলার চার্জশীটে তার চারটি নাম এসেছে। চার্জশীট অনুযায়ী সাদ্দামের প্রকৃত নাম সাদ্দাম হোসেন। পিতার নাম আলম মিয়া ওরফে জোলা, মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চরবিদ্যানন্দ গ্রামের দোতলা মসজিদের কাছে। পুলিশ বলছে, ভয়ঙ্কর জঙ্গী ছিল সাদ্দাম। কুনিও হত্যায় অংশ নেয়া জঙ্গী মাসুদ রানা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তাতে প্রকাশ পায় সাদ্দামের নাম। বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। মাসুদ রানা জানায়, বিদেশী নাগরিক হত্যার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশ ছিল। দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারলে দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে এবং তখন দেশে ‘ইসলামিক অভ্যুত্থান’ করা সহজ হবে। তারই অংশ হিসেবে সাদ্দামের নেতৃত্বে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গী বাইক হাসান, মাসুদ রানা ও বিজয় মোটরসাইকেলযোগে আলুটারী গ্রামে গিয়ে কুনিওকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। কিলিং মিশনের ব্যবহৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ সাদ্দামের হেফাজতে থাকত। সে উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার ছিল। সাদ্দাম ২০১৫ সালের ১০ নবেম্বর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলারও চার্জশীটভুক্ত আসামি ছিল। জঙ্গী সাদ্দাম জেএমবির প্রথম সারির নেতা ছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছরে জেএমবি যতগুলো হত্যাকা- করেছে, তার বেশিরভাগেরই মূল পরিকল্পনাকারী ও অস্ত্রের যোগানদাতা ছিল সাদ্দাম। সে পঞ্চগড়ে মন্দিরের পুরোহিত হত্যাসহ রংপুর বিভাগে বিভিন্ন কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন ছিল নব্য জেএমবির সদস্য। কুনিও ছাড়াও রংপুরে মাজারের খাদেম রহমত আলী, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ মঠের প্রধান পুরোহিত ও কুড়িগ্রামের ধর্মান্তরিত হয়ে নব্য খ্রীস্টান হওয়া হোসেন আলী হত্যা, রংপুরের বাহাই নেতা রুহুল আমিন হত্যাচেষ্টা মামলার ঘটনায় চার্জশীটভুক্ত আসামি ছিল সাদ্দাম। এছাড়াও গাইবান্ধার চিকিৎসক দ্বীজেন্দ্র নাথ পাল দিপ্তী হত্যা, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ফজলে রাব্বি হত্যা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত হত্যা, নীলফামারীর কারবালার খাদেম হত্যাচেষ্টা ও দিনাজপুরে চিরিরবন্দরে চিকিৎসক বীরেন্দ্র হত্যাচেষ্টায় সে জড়িত ছিল। সাদ্দাম নব্য জেএমবি নেতা মারজানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি জঙ্গী হামলায় জড়িত ছিল এবং মারজানের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। হামলার বিষয়ে মারজানের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ ছিল সাদ্দামের। পুলিশ বলছে, গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ওরফে রাহুল এবং রাজীব গান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে সুভাষের বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। এদিকে শুক্রবার সকালে ধানম-ির নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জঙ্গীদের কেউ রেহাই পাবে না। সবাইকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। জোরালো তৎপরতার কারণে জঙ্গীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিহত দুজনকে অনেকদিন ধরে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছিল। পলাতক থাকা মুসাকে গ্রেফতারেও চেষ্টা চলছে। পলাতকরা দ্রুতই গ্রেফতার হবে।
×