ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রয়োজন কৌশলী পদক্ষেপ

নতুন বছরে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

নতুন বছরে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করাই বড় চ্যালেঞ্জ

তৌহিদুর রহমান ॥ নতুন বছরে ভারত ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করাটাই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কৌশলী পদক্ষেপ, তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন ও বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিও বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ভারত ও চীন এই দুই দেশ পরস্পর প্রতিযোগী। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভিত তৈরি হয়েছে। আর চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। গত বছর ঢাকা-বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তি হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে চীন সহায়তা করে আসছে। ভবিষ্যতেও উন্নয়নের প্রয়োজনে চীনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালে ঢাকা সফর করেন। সেই সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। আর গত বছর ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। মোদির সফরের সময় বাংলাদেশকে ভারত ২০০ কোটি ডলারের সহযোগিতার বিপরীতে চীনা প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফরে দুই হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বাংলাদেশকে বেশি পরিমাণ অর্থ সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে ভারতকে জবাব দিয়েছে চীন। এদিকে চীন ও ভারত উভয় দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। গত বছর চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ দু’টি সাবমেরিন ক্রয় করেছে। এছাড়া গত বছর চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চেং ওয়ানকুয়ান বাংলাদেশ সফর করেছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরও বাংলাদেশ সফর করেন। গত ৪৫ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ভারতীয় কোন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। মনোহর পারিকর বাংলাদেশকে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই অঞ্চলে চীন ও ভারত উভয় দেশই পরস্পরের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। আগামী দিনেও তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বাড়তে পারে। আর ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করাটাও বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কেননা চলতি বছর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, সামরিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিকেই বাংলাদেশকে প্রাধান্য দিতে হতে পারে। এদিকে চলতি বছর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু সামাল দেয়াটা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র। বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। আর এর আগে তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশে দুই ক্যাম্পে শুধু নিবন্ধিত রোহিঙ্গাই রয়েছে প্রায় ৩২ হাজার। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমানমারকে চাপ দেয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের নিকট ইতোমধ্যেই অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে তলবের পরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকার। আগামী দিনে রোহিঙ্গা ইস্যু সামাল দেয়াটাই সরকারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার প্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করে তারা। দমন অভিযানের মুখে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি চলতি মাসেই বাংলাদেশে বিশেষ দূত পাঠাচ্ছেন। বিশেষ দূত বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কি প্রস্তাব দেন, তার জন্য দেশী-বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা প্রতীক্ষা করছেন। আগামী ফেব্রুয়ারির মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা-দিল্লী। শেখ হাসিনার সফরে ঢাকার পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর তিস্তা চুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে ঢাকা। কেননা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় দু’টি সমস্যার মধ্যে একটি ছিল সীমান্ত চুক্তি, অপরটি তিস্তা চুক্তি। তবে নানা কারণে এই দু’টি চুক্তি একসাথে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। সে কারণে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করাটা বাংলাদেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এদিকে বিদেশী নাগরিক হত্যা, জঙ্গী তৎপরতা ও সন্ত্রাসবাদকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রধান বাধা বলে মনে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর জাপান মনে করে বাংলাদেশে বিনিয়োগে অন্যতম প্রধান সমস্যা আমলাতন্ত্র। বাংলাদেশে বিনিয়োগের সকল বাধা দূর করে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোটাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেন না রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি এখন অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারেও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ। সে কারণে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো আগামী দিনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
×