ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্দেশ্য প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের কল্যাণ

প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন হচ্ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী। তাদের পাঠানো টাকায় দেশে থাকা পরিবারে সুখ আসছে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও তাদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্সে সচল আছে দেশের অর্থনীতি। দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩ শতাংশই তাদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে আসে। দেশ গঠনে যাদের এতো অবদান, সেই প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের অধিকার ও কল্যাণে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নেই কোন আইন। নেই কোন কর্তৃপক্ষ। বহির্গমন অধ্যাদেশ ১৯৮২ বাতিল করে ২০১৩ সালে সরকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন প্রণয়ন করলেও প্রবাসীদের কল্যাণের কোন কথা উল্লেখ নেই তাতে। আইন ছাড়া বিধি দিয়েই চলছে ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড’। ফলে প্রবাসী ও তাদের পরিবারের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারছে না এ বোর্ড। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকার প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের কল্যাণে আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। গঠন করা হচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৬। জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মিশন ও কল্যাণ) মোহাম্মদ আজহারুল হকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে ‘প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৬’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন। যা গত ১৬ নবেম্বর প্রবাসী কল্যাণ সচিব বেগম শামছুন নাহারের কাছে জমা দেন তারা। গত ৫ ডিসেম্বর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দফতর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের খসড়া এই আইনের ওপর মতামত প্রদানের জন্য ৭ দিনের সময় দেয়া হয়। এ ব্যাপারে মোহাম্মদ আজহারুল হক একটি অনলাইনকে বলেন, আমরা একটা খসড়া আইন তৈরি করেছি। ২৯ ডিসেম্বর (প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থার মিটিং) এ খসড়ার ওপর প্রথম আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। এরপরে মন্ত্রণালয় অধীনস্থ সংস্থা ও দফতরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রাইভেট সেক্টরের লোকদের নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। এর পরে মন্ত্রণালয় আইনটি চূড়ান্ত করবে এবং পরবর্তীতে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে পার্লামেন্টে পাস হবে। তিনি বলেন, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড দীর্ঘদিন বিএমইটির অধীনে ছিল। বর্তমানে এটি আলাদা হয়ে কল্যাণমূলক কর্মকা- করছে। তারা যে যেসব কাজকর্ম করছে বা আগামীতে আরও করবে, এজন্য আইন প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই আইন করা হচ্ছে। ‘প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৬’-এর খসড়া থেকে জানা যায়, এ আইনটি পাস হওয়ার পর বর্তমান ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড’ বিলুপ্তি হয়ে সকল কার্যক্রম এই বোর্ড বা আইনের অধীনে পরিচালিত হবে। প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পরিষদ থাকবে। যাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব চেয়ারম্যান ও প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (ন্যূনতম যুগ্ম-সচিব মর্যাদা) সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া সরকার মনোনীত বিদেশ ফেরত দুইজন (একজন নারী), বিএমইটির ডিজি, বায়রা সভাপতি, বাংলাদেশে ব্যাংকের একজন পরিচালক এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মর্যাদার একজন করে কর্মকর্তা পরিচালনা বোর্ডের সদস্য থাকবেন। আইনটি পাস হলে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের চলমান কল্যাণমূলক কর্মকা-ের পাশাপাশি প্রবাসীকর্মী এবং তাদের পরিবারের জন্য হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ ও অর্থায়নসহ নানা কর্মকা- পরিচালনা করা যাবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জনশক্তি রফতানি শুরু করে। ওই বছর বিদেশে কর্মসংস্থান হয় ৬ হাজার ৮৭ জনের। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখে (২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৫)। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর রক্ত ঘামের পরিশ্রমের টাকায় তাদের পরিবারে সুখ ফিরে এসেছে। দেশের কল্যাণে অনন্য অবদান রাখছেন প্রবাসীরা। কিন্তু এসব প্রবাসী ও তাদের পরিবারের কল্যাণের জন্য স্বাধীনতা উত্তর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৪ দশকেও কোন আইন প্রণয়ন করা হয়নি। তাদের দেখাভালে গঠন করা হয়নি কোন কর্তৃপক্ষ। সূত্রে আরও জানা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুখ-দুঃখ দেখভালের জন্য ১৯৯০ সালে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনে ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল’ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এটি ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড’ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দীর্ঘদিন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অধীনেই এ কল্যাণ তহবিল এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড পরিচালিত হয়। বিএমইটির ডিজি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। অবশেষে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আলাদা সংস্থা হিসেবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ দেয়া হয়। প্রথমবারের মতো এ সংস্থাটির ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব গাজী মোহাম্মদ জুলহাস। প্রবাসে আটকে পড়া (বিপদগ্রস্ত) কর্মীদের দেশে ফেরত আনতে সহযোগিতা প্রদান, দুর্ঘটনায় আহত ও অসুস্থ প্রবাসী কর্মীকে আর্থিক সাহায্য, প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীর মৃতদেহ দেশে ফেরত আনা ও দাফনে আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ প্রবাসীদের সার্বিক কল্যাণে কাজ করে থাকে এই সংস্থাটি। এছাড়া প্রবাসীদের মেধাবী সন্তানদেরও শিক্ষা বৃত্তিসহ নানা কল্যাণমূলক কাজ করছে আইন ছাড়া বিধি দিয়ে পরিচালিত হওয়া ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। আইন না থাকায় প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের অধিকার সুরক্ষা ও কল্যাণে পদক্ষেপ নিতে পারছে না সংস্থাটি। এ অবস্থায় আইন করে প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা ও কল্যাণে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ‘প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৬’ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নুরুল ইসলাম বিএসসি প্রবাসীদের কল্যাণে একটি আইন করে কর্তৃপক্ষ করার তাগিদ দেন। ২০১৫ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের এক সভায় তিনি ‘প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আইন’ প্রণয়নের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি জানান, প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের জীবনমানের উন্নয়ন ও বহুমুখী কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড নামে একটি বোর্ড গঠন করা হবে। এজন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিগগির আইন পাসের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড আত্মপ্রকাশ করবে। এর ফলে প্রবাসী কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা ও নানাবিধ কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা মন্ত্রণালয়ের ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এই বোর্ড গঠন করা হলে প্রবাসী কর্মীদের শতভাগ বীমার আওতায় আনা হবে। তাদের জন্য হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রবাসীপল্লী (আবাসন), তাদের সন্তানদের জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রত্যাগত কর্মীদের জন্য সামাজিক পুনর্বাসন কর্মসূচী নেয়া সম্ভব হবে। নূরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, প্রবাসী কর্মীদের দ্রুত সেবাদান ও হয়রানিমুক্ত করতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে এ সেবা আরও গতিশীল হবে।
×