ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জড়িত ১২ জঙ্গীর ৫ জন ঘটনাস্থলেই নিহত ॥ অন্যরা পলাতক, দুজন আটক- নিহত কয়েকজন অভিযানে মরেছে

হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা ॥ ৬ মাসেও মামলার চার্জশীট হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ জানুয়ারি ২০১৭

হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলা ॥ ৬ মাসেও মামলার চার্জশীট হয়নি

শংকর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার পর ছয় মাস পূর্ণ হলো নববর্ষ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারিতে। বিদায়ী বছরে (২০১৬) ১ জুলাই রাত আটটায় নব্য জেএমবি জঙ্গীরা সন্ত্রাসী হামলা চালায় গুলশানের এই রেস্তরাঁয়। ছয় মাসেও এই জঙ্গী হামলা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) প্রদান করতে পারেনি পুলিশ। অবশ্য এ সময়ে একের পর এক জঙ্গী বিরোধী অভিযানে নব্য জেএমবির মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের মতে বেশিরভাগ জঙ্গী আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জঙ্গী দমনে দেশ-বিদেশে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট অভাবিত সাফল্য বয়ে এনেছে। ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে এমন সন্দেহভাজনের সংখ্যা প্রায় ৩৫। এদের মধ্যে আছে জঙ্গী হামলার মূল সমন্বয়ক, সমন্বয়ে সহযোগিতা ও রেকি, জঙ্গী প্রশিক্ষক, পরিকল্পনাকারী, বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, আশ্রয়দাতা, অর্থদাতা, মদদদাতা। হামলায় জড়িত ১২ জঙ্গী। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে ৫ জন। জড়িত অভিযোগে চিহ্নিত করা হয়েছে আরও ১১। চিহ্নিত এই ১১ জনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২ জন ভারতে পালিয়ে গেছে। বহুল আলোচিত এই জঙ্গী হামলায় এখনও পর্যন্ত মাত্র গ্রেফতার দেখানো হয়েছে দুই জনকে। এই দুজন হচ্ছে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে আহত অবস্থায় আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যান ও হামলার সময়ে ছাদে জঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপরত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক হাসনাত রেজা করিম। এর মধ্যে রাকিবুল হাসান রিগ্যান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। রিগ্যান গুলশান হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গীকে ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস নিয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে তদন্ত কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান হামলার মূল সমন্বয়ক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরী গত ২৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ নিহত হয়। গত ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় র‌্যাবের এক অভিযানে গুলশান হামলার অর্থদাতাদের এক নব্য জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে মানিক নিহত হয়। র‌্যাবের দাবি, সে নব্য জেএমবির কথিত আমীর আবু ইব্রাহীম আল হানিফ। এই হামলা সমন্বয়ে তাকে সহযোগিতা করে নূরুল ইসলাম মারজান, রাজীব গান্ধী, মামুনুর রশীদ রিপন, সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে মানিক, মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা, শরীফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও রাশেদ ওরফে র‌্যাশ। এদের মধ্যে মারজান, রাজীব, রিপন, মুসা, খালেদ ও রাশেদ পলাতক রয়েছে। রিপন ও খালেদ ভারতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার গুজব রয়েছে। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অর্থের যোগানদাতাদের মধ্যে দুবাইয়ে পলাতক মুফতি শফিকুর রহমান, পলাতক শীর্ষ জঙ্গী বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট নব্য জেএমবির জন্য অর্থ সংগ্রহ করে মূল সমন্বয়ক নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তামিম চৌধুরীর কাছে জমা দিত। এছাড়া ডাঃ রোকন নামে এক ব্যক্তি সপরিবারে সিরিয়া চলে যাওয়ার আগে মোটা অঙ্কের অর্থ নিহত হওয়ার আগে তামিমের কাছে দিয়ে গেছে বলে তদন্ত কর্তৃপক্ষের দাবি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান তারেক। এই দুজনই পরে পুলিশের পৃথক অভিযানে নিহত হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে এক অভিযানে জাহিদ নিহত হয়। এর আগেই ২৭ আগস্ট কল্যাণপুরে এক অভিযানে নিহত হয় রায়হান তারেক। এছাড়া এই ঘটনায় জুনায়েদ খান ও ইকবালের সম্পৃক্ততা পেলেও তাদের এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। গুলশান হামলার অস্ত্র ও গ্রেনেডের যোগানদাতা হিসেবে এখন পর্যন্ত ৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের মূল হোতা হলো জেএমবির শীর্ষ নেতা সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ। তার নির্দেশে, বড় মিজান, ছোট মিজান, জয়পুরহাটের সাগর, আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুর রহমান ওরফে ডাঃ তৌফিক অস্ত্র-গ্রেনেড সরবরাহ করে। চক্রটি গুলশান হামলার আগে থেকেই নব্য জেএমবিকে অস্ত্র-গ্রেনেড সরবরাহ করত। এদের মধ্যে তাহের, মিজানুর, সেলিম ও তৌফিককে ২ নবেম্বর ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তাদের পৃথক একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ছাড়াও গুলশান হামলায় অংশগ্রহণকারীদের আশ্রয়দাতা হলো তানভীর কাদেরী ও তার স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা ওরফে খাদিজা। তানভীর কাদেরী আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি সমন্বয়ে সহযোগিতাও করে। এছাড়া গুলশান হামলার বিষয়টি আগে থেকে জেনে বিভিন্ন পর্যায়ে হামলাকারীদের সহযোগিতা করেছে মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি, জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, মুসার স্ত্রী তৃষামণি, সুমনের স্ত্রী সারিকা ওরফে তাহিরা ও বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে এক অভিযানে তানভীর কাদেরী নিহত হয়। এছাড়া ওই আস্তানা থেকে তিন নারী জঙ্গী প্রিয়তি, শায়লা আফরিন ও আবেদাতুন ফাতেমাকে গ্রেফতার করার পর গুলশান হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত : গত ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় দেশী-বিদেশী ২০ নাগরিক নিহত হয়। এর মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানী, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশ এবং আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ও দুই বাংলাদেশী। এছাড়াও হামলার মুহূর্তে পুলিশী অভিযান শুরুর মুখে জঙ্গীদের হামলায় নিহত হন রবিউল ইসলাম ও সালাউদ্দিন খান নামে দুই পুলিশ কর্মকর্তা। আহত হন আরও অন্তত ২৫ পুলিশ। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোর নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নামে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। এছাড়া অভিযানে নিহত হয় সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নামে এক শেফ। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়ার পর জাকির হোসেন শাওন নামে আরেক তরুণ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। অভিযানের আগে ও পরে হলি আর্টিজান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এক জাপানী ও দুই শ্রীলঙ্কানসহ অন্তত ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে।
×