ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বললেন বগুড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল

চাঁপাই ক্যাম্প দখলকালে আমার গুলিতে লুটিয়ে পড়ে ৪ পাকসেনা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

চাঁপাই ক্যাম্প দখলকালে আমার গুলিতে লুটিয়ে পড়ে ৪ পাকসেনা

মোঃ হারেজুজ্জামান হারেজ, সান্তাহার, বগুড়া ॥ ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকিস্তানী ক্যাম্প দখল করতে গিয়ে সম্মুখযুদ্ধে আমার গুলিতে লুটিয়ে পড়ে চার পাকিস্তানী সৈন্য। সহযোগীরা দু’জনের লাশ নিয়ে পালিয়ে গেলেও পড়ে থাকে আরও দু’জন। কাছে গিয়ে একজনকে জীবিত দেখে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল এদেরই গুলিতে নিহত আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি! মনে পড়ল প্রতিশোধ নেয়ার ওয়াদা। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতের রাইফেলের বাট দিয়ে বেঁচে থাকা হানাদার সৈন্যের মাথা থেতলে দিয়ে হত্যা নিশ্চিত করি। মহান আল্লাহ্র দরবারে দুই হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করি মাত্র ছয় মাসের মধ্যে জন্মদাতা মায়ের খুনীদের হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পারার জন্য। আমাদের ওই যুদ্ধের নাম ছিল ‘চাঁপাই আর্মি ক্যাম্প দখল যুদ্ধ’। এই ক্যাম্প দখল করতে আমাদের সময় লেগেছিল একটানা ৭ দিন। এর আগে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরগাড়ারহাট ক্যাম্প ও গোমস্তাপুর থানা ক্যাম্প দকলকরেছি। তখন আমাদের দলনেতা বগুড়ার নুরুল ইসলাম হলেও দিকনির্দেশনা দিতেন বীরশ্রেষ্ট শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। আর এই চাঁপাই যুদ্ধেই শহীদ হন আমাদের সাহস বৃদ্ধির জন্য শেষ প্রশিক্ষণদাতা বীরশ্রেষ্ট ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্যার।’ বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপনে এভাবেই নিজের বীরত্বগাথার কথা শোনালেন বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম। তিনি আদমদিঘি উপজেলার সান্তাহার ইউনিয়নের পশ্চিম ছাতনি গ্রামের বাসিন্দা। একাত্তরে সেনা অফিসারদের স্যার বলার অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামের। মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সে সময় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী থাকায় মুক্তিযুদ্ধে যাবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে দেয় হানাদারদের গুলিতে আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল চোখের সামনে হানাদার বাহিনীর গুলিতে জন্মদাতা মায়ের করুণ মৃত্যু আমাকে তাৎক্ষণিক মুক্তিযুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা যোগায়। মায়ের মৃত্যুর সাত দিন পর গ্রামও আশপাশ এলাকার প্রায় ৪০ জনের সঙ্গে ভারতে রওনা দেই। সারা রাত হেঁটে প্রায় ৭০/৮০ কিলোমিটার দূরে নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার কোন এক গ্রামে পৌঁছার পর ভোর হয়ে যায়। নিরাপত্তার জন্য আমাদের দলনেতা (আমার পাশের গ্রাম ঢেঁকড়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম) পথচলা বন্ধ করে দিলেন। দিনযাপনের জন্য নিরাপদ জায়গা হিসাবে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। রাত গভীর হলে আবার শুরু হলো পথচলা। ভারতের খুব কাছাকাছি আত্রাই নদীর নিকট পৌঁছতে সকাল হয়ে গেল। ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে আত্রাই নদী পর হতে গিয়ে আমরা অস্ত্রধারী রাজাকারদের বাধার মুখে পড়ি। এক সঙ্গে এতজনের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইল রাজাকার দলপতি। এ সময় আমাদের মধ্যে প্রায় সবাই ভয়ে দিল ভোঁদৌড়। তাদের ধরতে রাজাকাররা ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমরা অবশিষ্ট ১১ জনও দৌড়ে ভারতে ঢুকে পড়ি। চলে যাই বালুরঘাটে।’ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল বললেন, ‘সেখানে দেখা পাই আমাদের এলাকার তৎকালীন এমপি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কছিম উদ্দিন আহমদ ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিলের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, তোমরা এখনি মধুপুর রিক্রুটিং ক্যাম্পে যাও। তোমাদের খাবার ব্যবস্থা করছি। সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর আমাদের প্রায় দেড় হাজার যুবককে ফলিং করা হলো বাছাইয়ের জন্য। প্রথম বাছাইয়ে টিকলাম আমিসহ আড়াই শ’। পরে ২১ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের ভারতীয় আর্মি ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হলো মালদহ জেলার মেহেদিপুর সীমান্তে, যেখানে ছিল ভারতীয় আর্মি ক্যাম্প। আর এপারে আরগাড়ারহাটে পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্প। মেহেদিপুরে আমাদের ট্রাক থেকে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থাকা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্যার আমাদের নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, এই মুহূর্তে যদি তোমাদের যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয় তাহলে তোমরা রাজি কি-না। তখন আমরা সবাই উচ্চস্বরে সম্মতি জানালাম। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের আগে আসা চার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের লাশ এসে ঢুকল সেখানে। এটা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন স্যারকে বললাম আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে গেরিলা হিসাবে পাঠানোর জন্য। একথা শুনে যারপরনাই রেগে গেলেন তিনি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি শান্তভাবে আমাদের বোঝাতে লাগলেন তোমরা সবাই ছাত্র না। এখনই তোমরা বললে দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বাড়িতে থেকে এসেছ, প্রশিক্ষণ নিয়েছ। কিন্তু মাত্র চারজনকে শহীদ হতে দেখে ভয় পেয়ে গেলে। তাহলে এই শহীদদের হত্যার প্রতিশোধ ও দেশকে শত্রুমুক্ত করবে কে? ঠিক আছে, আমি নিজে তোমাদের আরও ট্রেনিং দিচ্ছি। দেখবে তোমাদের ভয় থাকবে না আর। তাঁর একথা শুনে আমরা ফের উজ্জীবিত হয়ে উঠি। এটা বুঝতে পেরে তিনি বললেন, যাও সবাই খেয়ে বিশ্রাম নাও। দিনটি ছিল সম্ভবত ২২ নবেম্বর। এরপর তিনি হানাদারদের প্রথম দুই স্তর তথা রাজাকার ও মিলিশিয়াদের বিতাড়িত করে তিন নম্বর স্তর তথা কিভাবে পাকিস্তানী আর্মির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পরাস্ত করতে হবে সে প্রশিক্ষণ দিলেন তিন দিন ধরে। এতে আমাদের সব ভয় দূর হয়ে সাহস বহুগুণে বেড়ে গেল।’ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামের ভাষ্যÑ ‘এর পর দিন আমাদের নির্দেশ দেয়া হলো, সীমান্ত ঘেঁষা আরগাড়ারহাটে (বর্তমান চাঁপাই সীমান্তঘেঁষা) অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প দখল করতে হবে। দিকনির্দেশনা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। তিন দিকে খাল পরিবেষ্টিত আরগাড়ারহাট পৌঁছলাম সন্ধ্যার দিকে। দুইভাগে ভাগ হয়ে আমরা আক্রমণ করলাম। শুরু হলো গুলি পাল্টাগুলি। সুবেহ সাদেকের দিকে বিজয় নিশ্চিত হলো এ যুদ্ধে হতাহতের কোন ঘটনা ছাড়াই। বেশ কিছু অস্ত্র আর গোলা-বারুদ রেখেই পালিয়ে যায় পাক আর্মিরা। এর পর বেশ কয়েক দিন আমরা সেখানে অবস্থান করি। মুক্তাঞ্চল নিশ্চিত হবার পর ২৭ নবেম্বরের দিকে নির্দেশ এলো এবার বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার পাকিস্তানী ক্যাম্প শত্রুমুক্ত করতে হবে। রাতের বেলা আক্রমণ করা হলো গোমস্তাপুর আর্মি ক্যাম্পে। যুদ্ধ চলল একটানা ৩ দিন ৩ রাত। এ যুদ্ধে আমাদের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। পক্ষান্তরে তাদের কতজন সৈন্য মারা যায় তা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও পরে বেশ কিছু লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। এর পর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের দিকনির্দেশনায় রাতের অন্ধকারে তিন দলে ভাগ হয়ে আমরা আক্রমণ করি ক্যাম্পে। একটানা ৭ দিন লাগে চাঁপাই ক্যাম্প হানাদারমুক্ত করতে। এই যুদ্ধের সময় ৩/৪ দিনের মধ্যে আমাদের কাছে খবর আসে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্যারের শহীদ হবার দুঃসংবাদ।’ বলেই তিনি আবেগাপ্লুত হলেন, এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ধীরে ধীরে আবার বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে ১৪ ডিসেম্বর আমরা চাঁপাই ক্যাম্পও হানাদারমুক্ত করতে সক্ষম হই। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছাড়াও নাম না জানা আরও বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হবার কথা শুনেছি। চাঁপাই ক্যাম্প দখলের পরই নির্দেশ আসে রাজশাহী ক্যাম্প আক্রমণ করার। কিন্তু রাজশাহী পৌঁছে ১৬ ডিসেম্বর আমরা জেনে গেলাম দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শত্রুমুক্ত তথা স্বাধীন হয়ে গেছে। সবখানে পত্ পত্ করে উড়ছে স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকা।’Ñ বলার সময় পতাকার মতোই পত্ পত্ করে উড়ছিল যেন হৃদয়। তিনি আরও বলেন, ‘এরপর আরও ৩ মাস আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে রাখা হয়েছিল বিহারি অধ্যুষিত বগুড়ার সান্তাহার জংশন ও পাশের নওগাঁ শহরের গণমানুষের নিরাপত্তা দেখভালের জন্য।’ কেমন আছেনÑ প্রসঙ্গ উঠতেই মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একের পর এক যে সুযোগ সুবিধা দিয়ে চলেছেন তা সম্ভবত বিশ্বে বিরল। তার কথার সঙ্গে সুর মেলালেন সেখানে উপস্থিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও। এক ছেলে এক মেয়ের জনক মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম। ছেলে সৌদি প্রবাসী। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে-জামাই দু’জনই শিক্ষকতায় নিয়োজিত। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বেশ কয়েক বিঘা ফসলি জমি বর্গা দিয়ে পাওয়া ফসল দিয়ে চালান সংসার খরচ। কিন্তু এখনও মানসম্পন্ন বাড়ি করতে না পারার হতাশা কাজ করছে তাঁর মনে।
×