ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

এ আর রহমান সুরের জাদুকর

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

এ আর রহমান সুরের জাদুকর

এ আর রহমান। সারাবিশ্বে যিনি পরিচিত ‘মোজার্ট অব মাদ্রাজ’ নামে। আর তামিলনাড়ুবাসী তাকে সম্বোধন করে ‘ইসাই পুয়াল’ অর্থাৎ সঙ্গীতের ঝড় বলে। তার পরিচয় সঙ্গীত রচয়িতা, গায়ক, সুরকার, যন্ত্রশিল্পী, সঙ্গীত প্রযোজক এবং মানবতাবাদী। তিনি প্রাচ্যের ক্লাসিক্যাল মিউজিককে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করেছেন নতুন রূপে। অর্জন করেছেন ২টি একাডেমি এ্যাওয়ার্ড, ২টি গ্রামী, গোল্ডেন গ্লোব, চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পদক, ১৫ বার ফিল্ম ফেয়ার এ্যাওয়ার্ড ও সেই সঙ্গে সম্মানিক পিএইচডি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের। ভারত সরকার তাকে দিয়েছে ২০১০ এ ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্ম-ভূষণ। ২০০৯ এ তিনি উঠে আসেন টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের সেরা প্রভাবশালীদের তালিকায়। তিনি আছেন বেস্ট সেলিং রেকর্ডিং আর্টিস্টদের তালিকায়। তার সাফল্য ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। একজন মানবাতাবাদী হিসেবেও যে কোন চ্যারিটিতে বিশ্বজুড়ে তার উপস্থিতি নজরকাড়ে। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত দানেও তিনি ভারতের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি। তামিলনাড়ুর চেন্নাইতে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের জন্ম। পিতা আর কে শেখর সুরকার ও সঙ্গীত আয়োজক হিসেবে কাজ করতেন তামিল ও মালায়লাম ছবিতে। নয় বছর বয়সে বাবাকে হারান, সংসার চলত বাবার বাদ্যযন্ত্র ভাড়া দিয়ে যা দেখভাল করতেন মা কাস্তরী। শৈশবে বাল্যবন্ধু শিভামালি, এন্থনি, জোজোর ব্যান্ড ‘রুটসে’ কী-বোর্ড বাজাতেন। পরে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যান্ড ‘চেন্নাই নেমেসিস’। তখনই বাজাতে পারতেন কী-বোর্ড, পিয়ানো, সিনথেসিজার, হারমোনিয়াম আর গিটার। কিন্তু তখন থেকেই তার মূল আকর্ষণ ছিল সিনথেসিজার। তার মতে এটি হলো সঙ্গীত আর প্রযুক্তির অনন্য সমন্বয়। মাস্টার ধনরাজের অধীনে আর প্রচলিত সঙ্গীত শিক্ষার শুরু। এগারো বছর বয়সে পিতৃবন্ধু এম. কে অজুর্নালের অকেস্ট্রায় যোগ দেন। অল্প দিনেই কাজ শুরু করেন এম এস বিশ্বনাথন, ইলাইয়া রাজা, রাজ কোটির মতো সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে। কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত জাকির হুসেইন, কুন্নাকুতি বিদ্যানাথন, এল শংকরের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে। ট্রিনটি কলেজ অব লন্ডনের বৃত্তি নিয়ে ট্রিনটি কলেজ অব মিউজিক থেকে সম্মানের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ওপর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তখনও তার পরিচয় আর এস দিলীপ কুমার। ছোট বোনের গুরুতর অসুস্থতাকালীন ১৯৮৪ ও তিনি জনৈক পীর সাহেবের মারফত ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৮৯ এ সপরিবারে ২৩ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে আর এস দিলীপ কুমার পরিবর্তন করে নাম রাখেন এ আর রহমান যা আজ বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তার শুরুটা ডকুমেন্টারির জন্য মিউজিক আর ইন্ডিয়ান টেলিভিশনের জন্য জিঙ্গেল নির্মাণের মাধ্যমে। ১৯৮৭ তে তখনও তিনি দিলীপ নামে পরিচিত প্রথম জিঙ্গেল নির্মাণ করেন অনইয়েন ঘড়ির জন্য। তার পর একে একে বিজ্ঞাপনের সাফল্য তাকে পরিচিত করে তুলে ভারতব্যাপী যার অন্যতম ছিল ‘টাইটান’ ঘড়ির বিজ্ঞাপন। যেখানে তিনি ব্যবহার করেন মোজার্টের স্মিফনি নং ২৫। তার ফিল্ম ক্যারিয়ার শুরু মনিরতœমের তামিল ছবি ‘রোজা’তে ১৯৯২-এ। তার নিজস্ব রেকর্ডিং স্টুডিও ‘পঞ্চাথন ইন’ । যা আজ কেবল ভারত নয় এশিয়ার সর্বাধুনিক রেকর্ডিং স্টুডিও বলে বিবেচিত। শিভাল ব্রাদার্স পরিচালিত মালায়লাম ছবি যোদ্ধাতে শুরু সুর করেন যা মুক্তি পায় সেপ্টেম্বর ১৯৯২-এ। সে বছরই ‘রোজার’ জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে জানিয়ে দেন তার আগামনী বার্তা। তারপর ‘বোম্বো’ ‘জেন্টেলম্যান’-এর সাফল্যের গল্প। জাপানী শ্রোতাদের মন কেড়ে নেন ‘মুথ্যুস’ ছবিতে। বহুমাত্রিক সুরের জন্য তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ভারতজুড়ে। সংমিশ্রণ ঘটান পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যালের সঙ্গে কনাটর্ক আর তামিল ঐতিহ্যবাহী ফোক, জ্যাজ, রক আর রেগের। বোম্বে ছবির সাউন্ড ট্র্যাক বিক্রি হয় ১২ মিলিয়নের বেশি। তার বলিউডে যাত্রা শুরু রাম গোপাল ভার্মা’র ‘রঙ্গিলা’ দিয়ে এরপর দিল সে, তাল এর মতি ছবি তাকে নিয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তার সুফী সঙ্গীত অনুপ্রাণিত ‘ছাইয়া ছাইয়া’ আর ‘জিকির’ এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। কাজ করেছেন ‘স্বদেশ’ ‘রং দে বাসন্তী’, ‘জিনস‘, ‘ইন্ডিয়ান’ ‘নায়ক‘ ‘শিভাজির’ মতো ছবিতে। ২০০৫-এ তার রেকর্ডিং স্টুডিও সম্প্রসারিত করেন নতুন নাম ‘এ এম স্টুডিও’ নামে। প্রচলন করেন তার মিউজিক লেবেল কে. এম. মিউজিক। চাইনিজ ও জাপানিজ ক্লাসিক্যাল সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে সুর দেন ‘ওয়ারিয়ারস অব হেভেন এ্যান্ড আর্থ’ ছবিতে। ২০০৭ এ প্রথম ইংরেজী ছবি ‘এলিজাবেথ’ আর ‘যোধা আকবর’ এ সুর করে পান ‘এশিয়ান ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড।’ ২০০৯ এ হলিউড ডেবু ‘কাপলস রিট্রিট’ ছবিতে। এদিকে ২০০৮ এ ‘সø্যামডগ মিলিওনিয়ার’ জিতে নেয় গোল্ডেন গ্লোব ও ২টি একাডেমি এ্যাওয়ার্ড। ২০১৪ ছিল তার জীবনের ব্যস্ততম বছর মুক্তি পায় বিভিন্ন ভাষায় ১২টি ছবি। প্রথম রিলিজ ইমতিয়াজ আলীর ‘হাইওয়ে’। হলিউডে সুর করা দুটি ছবি মিলিয়ন ডলার ও ‘দি হানড্রেড ফুট জার্নি’ মনোনয়ন পান অস্কার তালিকায়। ভারতের পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে করা ‘বন্দে মাতরম’ এখন ভারতে সর্বাধিক বিক্রীত নন ফিল্মি রেকর্ড, ১৯৯৯ এ নৃত্য পরিচালক শোভনা আর প্রভুদেবাকে নিয়ে কাজ করেন মাইকেল জ্যাকসনের জার্মানীর কনসার্টে। তার স্টেজে যাত্রা শুরু ২০০২ এ ‘বোম্বে ড্রিমস’ নামে সঙ্গে এন্ড্রু লয়েড ওয়েবার। ফিনিশ ফোক মিউজিক ব্যান্ড ‘ভারটিনা’র সঙ্গে ‘লর্ড অব দি রিংস’-এর টরেন্টো প্রোডাকশনে কাজ করেন, ২০০৪ থেকে শুরু করে তিনটি সফল ওর্য়ার্ল্ড ট্যুর করেছেন আর ক্যারেন ডেভিডের সঙ্গে স্টুডিও এ্যালবাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমেরিকা সফরের সময় বারাক ওবামার আমন্ত্রণে ২৪ নবেম্বর ২০০৯ এ পারফর্ম করেন হোয়াইট হাউসের স্টেট ডিনারে। তিনি সারা বিশ্ব থেকে বেছে নেয়া ৭০ জন শিল্পীর একজন যিনি হাইতির ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে প্রকাশিত এ্যালবামে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ‘লন্ডন ফিলহারমোনিক অকেস্ট্রা’ মাইকেল বোলটনের সঙ্গে। ২০ মে ২০১১তে মিক জ্যাগার সুপারহেভি নামে যে সুপারগ্রুপ গ্রুপ গঠন করেন সেখানে ডেড স্টুয়ার্ট, ড্যাশ স্টোন, ডেমিয়েন মার্লের সঙ্গে আছেন রহমান। ২০১২তে সুর করেন লন্ডন অলিম্পিকের ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য। রহমানের দক্ষতা কর্নাটকি সঙ্গীত থেকে পাশ্চাত্য হিন্দুস্তানী ক্লাসিক্যাল মিউজিকে। নিয়েছেন নুসরাত ফাতেহ আলী খানের কাওয়ালী থেকে। মিশ্রণ ঘটিয়েছেন প্রাচ্যের সঙ্গীত যন্ত্রের সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক শব্দ আর প্রযুক্তি। যন্ত্রসঙ্গীত আর কন্ঠের অপূর্ব সমন্বয়। সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছেন বিশ্বখ্যাত ইরানী পরিচালক মাজেদ মাজেদির ছবি মোহাম্মদে সুর করে। আল্লা রাখা রহমান এক সঙ্গীত ঝড়ের নাম, সুরের জাদুকর। যার রোজা ছবির সুর নিয়ে রিচার্ড কর্লিস বলেছিলেন, ‘চমকে দেয়া শুরু! উনি সবাইকে ধারণ করে একান্তই তামিল! এবং একান্তই রহমান।’ দীর্ঘ পথ পেরিয়েও তিনি এখনও তাই। রণ ফেয়ারের সঙ্গে আমরাও একমত যখন তিনি বলেন, ‘যে কোন মাধ্যমে পৃথিবীর সেরা জীবিত সুরকারদের একজন এ আর রহমান।’
×