ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাক্ষাতকারে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ খান চৌধুরী

ভোমরা যুদ্ধে ৩শ’ পাকসেনা নিহত হয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

ভোমরা যুদ্ধে ৩শ’ পাকসেনা নিহত হয়

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্তের ওপারে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা গ্রাম। ইপিআর বাহিনীর সহযোগিতায় প্রায় ৪০ জন দামাল ছেলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সেখানে অবস্থান করছিলেন। এপ্রিলে প্রথম দফা যুদ্ধের পর ভোমরা সীমান্ত তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। ২৯ মে, ১৯৭১। রাত ৩টার দিকে পাক সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ আক্রমণ করে। এটি ছিল হঠাৎ আক্রমণ। পাকি সেনারা এ যুদ্ধে ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে। তারা স্ক্রলিং করে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এই যুদ্ধ চলে পরদিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রায় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধেরই এক বীর সৈনিক সাতক্ষীরার মাসুদ খান চৌধুরী স্মৃতিচারণে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা। ১৯৭১ সালে মাসুদ খান চৌধুরী সাতক্ষীরা সরকারী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার। তিনি সহযোগী হিসেবে পান ছাত্রলীগের সাতক্ষীরা মহকুমার সাধারণ সম্পাদক ও সাতক্ষীরা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদক কামরুল ইসলাম খান (বর্তমানে জনকণ্ঠের প্রধান বার্তা সম্পাদক), হাবলু, কাজল, নাজমুল, ইনামুল, কামরুছামা, বদরুলসহ অনেকে। নেতৃত্বের সঙ্কটের মধ্যে তারা পেয়েছিলেন এমএনএ গফুরকে। তার নেতৃত্বে তারা সংগঠিত হন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর তারা দেখতে পান মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) অফিসে উড়ছে পাকিস্তানী পতাকা। সকলে গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন এসডিও অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামাতে হবে। ৭১ সালের ২৯ মার্চ কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ খান চৌধুরী, আব্দুস সালাম, হাবলু, কালো খসরু, সকলে মিলে মিলিত হন এসডিও অফিসের সামনে। আব্দুস সালামের নির্দেশে কামরুল ইসলাম খান অফিসের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে আনেন। অফিসের সামনে বকুল তলায় আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় পাকিস্তানী পতাকা। এরপর সেখানে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এই পতাকা উত্তোলন দেখতে সেখানে জড়ো হন শত শত মানুষ। এই ঘটনায় জেলা জুড়ে মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় নব জাগরণ। এই তরুণ যুবকরা এমএনএ আব্দুল গফুর আর সুবেদার আয়ুব আলির নেতৃত্বে ভোমরা কাস্টমস অফিসের বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গায় গড়ে তোলেন মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প। সেখানে ট্রেনিং চলার মধ্যে বরিশালের মঞ্জুর নেতৃত্বে সাতক্ষীরার মুসলিম লীগের নেতা বাটকেখালি গ্রামের আব্দুল গফুরের বাড়ি থেকে সাতক্ষীরার অবাঙালী এসডিওকে ধরে নিয়ে আনা হয় ভোমরা ক্যাম্পে। পরে তাকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভোমরা সীমান্তে কাস্টমস অফিস আর ইপিআর ক্যাম্প ছিল। একটি সরু খাল ছিল দু’দেশের মাঝখানে। ভোমরার ওপারে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা গ্রামে ইপিআর বাহিনীর সহযোগিতায় এই দামাল ছেলেরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেন। অস্ত্র বলতে ছিল শুধু থ্রিনট থ্রি রাইফেল। এই মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে কামরুল ইসলাম খান, মোস্তাফিজুর রহমান, সম বাবর আলি, হাবলু, আব্দুস সালাম, কাজল, নাজমুল, ইনামুল, কামরুছামা, বদরুলসহ আমরা ৩০ থেকে ৪০ জনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। এখানে সকলেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। এই ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে ২৯ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সকালে গোসল করার সময় প্রথম পাকবাহিনীর গুলির শব্দ শুনতে পান। গোসল ফেলে সকলে ছুটে যান ইপিআর ক্যাম্পে। ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে মিলে অস্ত্র ধরেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে। সাতক্ষীরা থেকে পাক সেনারা গাড়ি করে অতি গোপনে ভোমরায় এসে এই আক্রমণ চালায়। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে চলে গোলাগুলি। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীরা ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন ইপিআর সুবেদার আয়ুব আলি। এই যুদ্ধ দিয়েই প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেন মুক্তিযুদ্ধের এই দলটি। এই যুদ্ধে কোন প্রাণহানি হয়নি। প্রায় ১ মাস পরে ২৯ মে ভোমরার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ভোমরা সীমান্ত অঞ্চল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে তখন পাকবাহিনী রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ আক্রমণ করে। এটি ছিল অতর্কিত আক্রমণ। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে। মুক্তি বাহিনীর জন্য এই যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধ পরিচালনা করেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও এসডিপিও মাহবুব। যুদ্ধ পরিচালনায় যারা সহযোগিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে সুবেদার আয়ুব আলি, সুবেদার সামছুল হক, সুবেদার আব্দুল জব্বারসহ দুই কোম্পানি ইপিআর সদস্য এবং মুক্তিকামী তরুণ বীর সদস্যরা। রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্রলিং করে মুক্তিবাহিনীর বাংকারের দিকে আসতে থাকে। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই যুদ্ধ চলে পর দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের প্রায় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ সৈন্য মারা যায়। পাক সেনারা মৃত সৈন্যদের ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যায় যশোর সেনানিবাসে। মৃত পাকি সৈন্যদের রক্তের চিহ্ন ভোমরা থেকে সাতক্ষীরা হয়ে যশোর পর্যন্ত রাস্তায় ছিল অনেক দিন। এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ২২ এফএম পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদের মৃতদেহ বেড়ির ওপর থেকে ভারতে তুলে নেয়ার সময় পাকসেনাদের গুলিতে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের মৃতদেহ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের আমবাগান ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে এই পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের মৃতদেহ দেখতে বশিরহাটসহ অনেক এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ দেখতে আসে এবং জয়বাংলা সেøাগানে মুখরিত করে তোলে। এই যুদ্ধে মাসুদ খান ছাড়াও যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে কামরুল ইসলাম খান, হাবলু, কাজল, নাজমুল, সম বাবার আলি, কামরুছামা, আব্দুস সালাম, মুস্তাফিজুর রহমান ইনামুল বদরুলসহ আরও অনেকে। এর কিছুদিন পর টাকিতে মেজর এম এ জলিলের ক্যাম্পে যান মুক্তিযোদ্ধারা। সেখান থেকে টাউন শ্রীপুরে যুদ্ধে অংশ নেন এই দলটি। ওই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টার। এই যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এদের মধ্যে অন্যতম শহীদ কাজল, নাজমুল, নারায়ন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন হাবলু। এরপর পাইকগাছা ও কপিলমুনি যুদ্ধে তারা অংশ নেন। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর এই বীর মুক্তিসেনা সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন।
×