ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আতিউর রহমান বলেছেন সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়নি

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সাবেক গবর্নরকে জিজ্ঞাসাবাদ?

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সাবেক গবর্নরকে জিজ্ঞাসাবাদ?

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রিজার্ভ চুরির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। টানা প্রায় দুই ঘণ্টা সিআইডির একটি প্রতিনিধি দল ধানম-ির বাসায় সাবেক গবর্নরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। গর্বনরের কাছে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। রিজার্ভ চুরির অনেক পরে মামলা দায়ের, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করার কারণ, ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সিস্টেম উন্নয়নের জন্য সুইফটের কাজ করার প্রয়োজনীয়তাসহ নানা বিষয় সম্পর্কে সিআইডি কর্মকর্তারা সাবেক গবর্নরের কাছে জানতে চান। সাবেক গবর্নর অনেক প্রশ্নেরই সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। সিআইডি বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলছেন, সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়নি। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সোমবার সকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমানের বাসায় যান। সেখানেই সাবেক গবর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে সিআইডি কর্মকর্তাদের কথা হয়। সূত্র বলছে, সকাল দশটা থেকে দুপুর বারোটা নাগাদ টানা প্রায় দুই ঘণ্টা সিআইডি কর্মকর্তারা সাবেক গবর্নরের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেন সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৪ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০ মিলিয়ন শ্রীলঙ্কার শালিখা নামের একটি এনজিওর ফান্ডে জমা হয়। টাকাগুলো ফেরত দিয়েছে দেশটি। বাকি ৮১ মিলিয়ন চলে যায় হ্যাকারদের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আগাগোড়াই চেপে যান। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি। এদিন ফিলিপিন্সের ইনকোয়ার পত্রিকায় এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ পায়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। এরপর শুরু হয় তুমুল হৈচৈ। বাকি ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যায় ফিলিপিন্সে। ফিলিপিন্স থেকে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। আরও ২১ মিলিয়ন অর্থাৎ ২১০ কোটি টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই টাকাগুলো ফেরত আসছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় চলতি বছরের ১৫ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির হিসাব ও বাজেট বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়। একজন উর্ধতন সিআইডি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফিলিপিন্সের পত্রিকায় এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে রিজার্ভ চুরির বিষয়টি আরও অনেক দিন গোপনেই থাকা অসম্ভব ছিল না। এ বিষয়টি ছাড়াও রিজার্ভ চুরির দীর্ঘ সময় পর মামলা দায়েরের কারণ সম্পর্কে সিআইডি কর্মকর্তারা সাবেক গবর্নরের কাছে জানতে চান। চুরির পর পরই বিষয়টি স্বাভাবিক নিয়মে গবর্নরের জানার কথা। সেই প্রক্রিয়াটি মানা হয়েছে কিনা। সে প্রক্রিয়া না মানার কারণ সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। বিষয়টি জানার পর পরই অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়েছিল কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে গবর্নরের কাছে। নেটওয়ার্ক সিস্টেম উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও বহু বিষয়ে সাবেক গবর্নরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি তেমন কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ শাখা মনিটরিং করার জন্য একটি বিশেষ সেল রয়েছে। যার জন্য পৃথক কম্পিউটার রয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা এখন পর্যন্ত ৬৬ কম্পিউটারের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত রিজার্ভ সেল মেইনটেইন করার জন্য কম্পিউটারগুলো সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা সেলটি পালাক্রমে চব্বিশ ঘণ্টাই মনিটরিং করার কথা। সেলটি মনিটরিং করার জন্য ২২ জন আইটি বিশেষজ্ঞ রয়েছে। যাদের দুইজন ব্যতীত বাকিদের আইটি সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান নেই। আগে কাটআউট পদ্ধতিতে রিজার্ভ সেলটি মেইনটেইন করা হতো। অর্থাৎ ওই সেলটির কম্পিউটারের সঙ্গে অন্য কোন কম্পিউটারের যোগাযোগ স্থাপন করার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটির নেটওয়ার্কিং সিস্টেম উন্নত করার জন্য কাজ করায়। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকের মানি ট্রান্সফারসহ নিরাপত্তার কাজ করার সঙ্গে জড়িত সুইফট বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সিস্টেম উন্নত করার কাজটি করে দেয়। সুইফটের সাত জন গত বছরের আগস্ট থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত পুরোদমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কের কাজ করে চলে যান। সূইফটের আগের ৭ জন চলে যাওয়ার পর সুইফটের টেকনিশিয়ান পরিচয়ে আরও একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং সিস্টেমে কাজ শুরু করেন। কয়েকদিন কাজ করার পর তার কাজ কর্মে ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের সন্দেহ হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ওই ব্যক্তি ঠিকাদার বলে প্রকাশ পায়। এরপর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে তার নেটওয়ার্কিং কাজ করতে নিষেধ করা হয়। ততদিনে ওই ঠিকাদার সার্ভার স্টেশনে একটি নতুন কম্পিউটার বসিয়ে দেন। এমনকি ওই কম্পিউটারের সঙ্গে রিজার্ভের ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা প্রায় সাড়ে চার হাজার কম্পিউটার যুক্ত করে দেন। নতুন কম্পিউটারে তিনি একটি বিশেষ চিপ বসিয়ে দেন। চিপটি চব্বিশ ঘণ্টাই কম্পিউটারের সঙ্গে লাগিয়ে রাখার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট আইটি বিশেষজ্ঞদের। তিনি সব কম্পিউটার পরিচালনার জন্য রিমোট সিস্টেম চালু রাখেন। এটি এমন একটি সিস্টেম, পৃথিবীর যেকোন জায়গায় বসে রিমোট সিস্টেমের আওতায় থাকা সব কম্পিউটার পরিচালনা করা সম্ভব। এতে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সিস্টেম পুরোপুরি এক হয়ে যায়। এ ধরনের কাজ করার পর কম্পিউটার সুরক্ষিত রাখার জন্য যে ধরনের ফায়ার ওয়াল ও ম্যানেজেবল সিস্টেম ব্যবহার করা কথা তা করা হয়নি। উল্টো কম্পিউটার সুরক্ষিত না করে সেকেন্ডহ্যান্ড একটি আন ম্যানেজেবল সুইচ ব্যবহার করা হয়। এতে করে পুরো সিস্টেম অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এমন দুর্বল ব্যবস্থার কারণে হ্যাকারদের পক্ষে সার্ভার হ্যাক করে রিজার্ভ চুরি সহজ হয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ঘটে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, ফিলিপিন্সের তরফ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চেপে যায়। তারা ভেতরে ভেতরে টাকা ফেরত আনতে নানা তৎপরতা শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি তিনদিনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্টস এ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ডিজিএম জাকের হোসেন ও বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফিন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রবকে ফিলিপিন্সে পাঠানো হয়। তারা সেখানে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংকো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপিন্স’ (বিএসপি) ও এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) সঙ্গে আলাদা আলাদ বৈঠক করেন। বৈঠকে হ্যাকার গ্রুপকে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ফিলিপিন্সের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গবর্নর ও সে দেশটির রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও যোগাযোগ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা দ্রুত টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে ফিলিপিন্সের সহযোগিতা চায়। দুই কর্মকর্তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয় সে দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাংক ও এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল এং ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে। এমন আশ্বাস পেয়ে ওই দুই কর্মকর্তা দেশে ফেরত আসেন। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমানসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করেন। পরে এ বিষয়ে গবর্নরসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘন ঘন বৈঠক করতে থাকেন। বৈঠকে টাকা চুরির বিষয়টি প্রকাশ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কারণ গবর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের ধারণা ছিল, স্বল্প সময়ের মধ্যেই যেহেতু টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এমন খবর সরকার বা সংশ্লিষ্টদের না জানানোই ভাল। এ জন্য বিষয়টি চেপে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই দুই কর্মকর্তাসহ শতাধিক কর্মকর্তাকে এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। এই প্রথমবারের মতো এখন পর্যন্ত তদন্তে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে সাবেক গবর্নরের কাছে জানতে চায় সিআইডি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অনেক বিষয় সম্পর্কেই সাবেক গবর্নর সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে পারেননি।
×