ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের সীমাবদ্ধতায় প্রত্ন সম্পদ যথাযথ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬

আইনের সীমাবদ্ধতায় প্রত্ন সম্পদ যথাযথ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না

সমুদ্র হক ॥ দেশে ইতিহাসের চিহ্ন প্রতœ ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুগোপযোগী আইন না থাকায় ঐতিহ্যের এই সম্পদ ঠিকমতো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ইউনেস্কো বলেছে, সদস্য দেশগুলো তাদের স্বাধীনতা স্বাতন্ত্র্য ঐতিহ্যের সকল চিহ্ন এমনকি ইমারতগুলো সংরক্ষণ করবে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত যে আইন বিদ্যমান তার ফাঁকফোকর গলিয়ে আমাদের অনেক প্রতœ ও সাংস্কৃতিক সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আরেকদিকে আমাদের বহু প্রাচীন নিদর্শন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কখনও দুর্বৃত্তরা ঢিবি, পীঠ বা ভিটা হিসেবে পরিচিত উঁচু ভূমি (প্রতœ ভাষায় মাউন্ট) কেটে সমতল করছে। ঐতিহাসিক নগরীর প্রতœ ইট চুরি করে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে প্রতœসম্পদ এলাকা খনন করে সম্পদ লুট করা হচ্ছে। কঠিন আইন না থাকায় প্রতœসম্পদ লুট করাকে চুরি হিসেবে দেখানো হয়। অপরাধীরা দ্রুত ছাড়া পেয়ে ফের অপরাধের পথে পা বাড়ায়। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে পুরাকীর্তি রক্ষায় তিনটি আইন আছে। ট্রেজারারাস ট্রুভ এ্যাক্ট ১৮৭৮, এ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজারভেশন এ্যাক্ট ১৯০৪, এ্যান্টিকুইটিজ এ্যাক্ট ১৯৪৭। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত এ তিনটি আইন হুবহু রেখে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান পেনাল কোড তৈরি হয়। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর আইনগুলো একই রেখে বাংলাদেশ পেনাল কোড তৈরি হয়। দিনে দিনে অপরাধের ধরন পাল্টে যাওয়ায় প্রতœ ও সাংস্কৃতিক সম্পদ নানাভাবে নানা কৌশলে লুট করা হচ্ছে। প্রতœসম্পদ লুটেরারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। তারা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে সাধারণ ছিঁচকে চোর দিয়ে বড় কাজ সেরে নেয়। কালেভদ্রে এই চোরেরা ধরা পড়ে। তবে কঠিন আইন না থাকায় সব সময়ই পার পেয়ে যায়। অনেক সময় চোরকে থানা পর্যন্ত নেয়া যায় না সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে। ঐতিহ্যের সম্পদ রক্ষার প্রথম আইন ট্রেজারারাস ট্রুভ এ্যাক্টের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেÑ প্রতœসম্পদ প্রাপ্তির সময় থেকে মাটির ওপরে ও নিচে থাকা যে কোন বস্তু এক শ’ বছরের পুরনো হলেই তার মালিক সরকার। এই বস্তু নিকটের ট্রেজারিতে জমা করা বাধ্যতামূলক। আইনটি ১৮৯১ এবং ১৯০৭ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। তারপরও আইনটি দিয়ে বর্তমানে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। আইনটিকে একবিংশ শতকের উপযোগী করে তোলা দরকারÑ এমনটি মনে করেন ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ববিদগণ। এ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্টস প্রিজারভেশন এ্যাক্টটি ১৯০৪ সালে প্রণীত হয়। পুরাকীর্তি পাচার রোধ, ঐতিহ্যের অবকাঠামো রক্ষা, প্রতœতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এ আইন প্রয়োগে অনেক সময় একাধিক সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন কোন প্রাচীন ইমরত নড়বড়ে হয়ে পড়লে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। জানমাল রক্ষায় কর্তৃপক্ষ এ ইমারত ভেঙ্গে ফেললে আইনে আটকানো যায় না। দেশের অনেক প্রাচীন ইমারত এভাবে ভেঙ্গে ফেলে তার ওপর আধুনিক শৈলীতে ইমারত নির্মিত হয়েছে। দেশের মূল্যবান সম্পদ পুরাকীর্তি পাচারকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সূত্র জানায়, অনেক সময় পুরাকীর্তি পাচারের সঙ্গে অনেক রাঘববোয়াল, অতি প্রভাবশালী, রথিমহারথিরা জড়িত থাকে। সহজে তাদের আঁচড় পর্যন্ত দেয়া যায় না। বর্তমান সময়ের পুরাকীর্তি লুট ও পাচারের মতো কৌশলী অপরাধ এ আইন দিয়ে মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। আইনের আরও আপডেট দরকার, এমনটি মনে করেন ইতিহাস বিভাগের কয়েক শিক্ষক। এ্যান্টিকুইটিজ এ্যাক্টটি অনেকটাই এক্সপোর্ট কন্ট্রোল। বাংলা করলে দাঁড়ায় রফতানি নিয়ন্ত্রণ। এ আইনে বিশাল বিশাল ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। এ আইনবলে সরকারের অনুমতি এবং অনুমোদন নিয়ে পুরাকীর্তি রফতানি করা যেতে পারে। মুখোশের আড়ালে বড় অপরাধীরা সুকৌশলে সরকারের নাকের ডগায় সরকারী অনুমতি নিয়ে দেশের মহামূল্যবান প্রতœসম্পদ বিদেশে পাঠাতে পারে। প্রতœতত্ত্ববিদগণ বলছেন এ তিন আইনের যত ফাঁকফোকর আছে তা বন্ধ করে একবিংশ শতকের উপযোগী করে আইনগুলোর সংশোধনী আনা দরকার। মাঠপর্যায়ে প্রতœসম্পদের অবস্থানে ইতোমধ্যে দুর্বৃত্তদের হানা পড়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের আশপাশে অন্তত দশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে ঢিবিগুলো (মাউন্ট) আছে তার বেশিরভাগই বেআইনী দখল করে সমতল করা হয়েছে। বগুড়ার গোকুল এলাকায় অন্তত দশটি মাউন্ট কেটে সমতল ভূমি করে দখল করা হয়েছে। সেখানে কোথাও আবাদ করা হয়েছে। কোথাও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে, যা খালি চোখে দেখা যায়। বগুড়া শহরতলী এলাকায় ভীমের জাঙ্গাল নামের সবুজ উঁচু ভূমির অস্তিত্ব দিনে দিনে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, যা ছিল ইতিহাসের পাতার নানান ঘটনার সাক্ষী, তাতে ভূমিগ্রাসীদের চোখ পড়েছে। এসব প্রতœ মাউন্ট দখল করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার অনেক ঐতিহাসিক ইমারত ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব না বুঝেই সম্প্রসারণ ও সংস্কারের নামে ভেঙ্গে আধুনিক স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। একজন ইতিহাসবিদ বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশে তাদের ইতিহাসের স্থাপনা নষ্ট করা হয় না। প্রাচীন নক্সায় অবকাঠামোটি পুনর্নির্মিত হয়। ভারতের অনেক রাজ্যে প্রাচীন ইতিহাসের সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই আছে। যশোরের ডিসি অফিস (যা একসময় ছিল কালেক্টরেট ভবন) ছিল প্রাচীন আমলে নির্মিত একতলা। এই অবকাঠামোকে ভেঙ্গে অবিকল প্রাচীন নক্সায় তিনতলা করা হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে হানিক সংকেত অবকাঠামোটি (তিনতলা ইমারত) প্রদর্শনের সময় এভাবেই বর্ণনা দেন। যশোর প্রশাসন প্রাচীন কীর্তির ব্যত্যয় ঘটায়নি। ঢাকার নারিন্দায় সুলতানী আমলে নির্মিত বিনদ বিবির মসজিদটি ভেঙ্গে সেখানে ওই মসজিদের চেয়ে অনেক বড় আধুনিক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এ মসজিদটি ছিল প্রাচীন ইতিহাসের মুসলিম স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। মসজিদটি যেন ভেঙ্গে ফেলা না হয় এবং এই মসজিদকে ঠিক রেখে সম্প্রসারণের জন্য দাবি উঠেছিল। তা টেকেনি। রাজশাহী মহানগরীতে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে কান্ত কবি নামে খ্যাত রজনীকান্ত সেন, ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও স্যার যদুনাথ সরকারের বাসভবন। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে গত শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত ঢোপকল। পুঠিয়ার মহারানী হেমন্ত কুমারীর আর্থিক সহায়তায় ১৯৩৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল এক শ’টিরও বেশি ঢোপকল। নগরীর পানির চাহিদা মেটাতে ওয়াটার ওয়ার্কস প্লান্ট নামে পানি সরবরাহের প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন মহারানী। ভূগর্ভের পানি শোধন করে নগরীর মোড়ে মোড়ে স্থাপিত ঢোপকলে পানি পৌঁছে যেত। সুপেয় এই পানি সংগ্রহ করত নগরীর মানুষ। রাজশাহী মহানগরীকে সাজাতে এই ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, যা টিকে আছে তা রাখা হচ্ছে না। বলা হয় এই ঢোপকল জাদুঘরে পাঠানো হবে। নগরীর বিশিষ্টজনের কথাÑ ঐতিহ্য কখনও জাদুঘরে রেখে সংরক্ষণ করা যায় না। নিজস্ব জায়গায় রেখেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে হয়। বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, জগদ্দল বিহার, সোমপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর, মাগুরাসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে ঐতিহাসিক নিদর্শন নষ্ট করা হচ্ছে। দিনে দিনে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে নিকট ভবিষ্যতে অনেক প্রতœসম্পদের হদিসও শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে জাদুঘর রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। জাদুঘর বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়েছে। দেশে প্রতœতাত্ত্বিক লোকতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক নানান ধরনের জাদুঘর গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের তথা মহাকালের পরম্পরায় বহু প্রতœ নিদর্শন ও স্মারক অতীতের ঠিকানা আত্মপরিচয়ের দলিল। এ সম্পদ অমূল্য পুরাকীর্তি পুরাবস্তু দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে পুরাকীর্তি কোন অবস্থাতেই হাতছাড়া তো করা হয়ই না, নষ্ট করলেও তার কঠিন শাস্তি রয়েছে। আমাদের দেশে আইন থাকার পরও তা যুগোপযোগী না হওয়ায় অতিমূল্যবান প্রতœসম্পদ ঐতিহ্যগুলো দুর্বৃত্তের কবলে পড়ছে।
×