ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন বাকি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল পাক হানাদার বাহিনী। তারা চেয়েছিল বাঙালীকে মেধা ও মননশূন্য করতে। ১৯৭১ সালের এই দিনে তারা এ দেশীয় দালাল ও দোসরদের সহায়তায় বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের অগ্রগণ্য মানুষদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৪ ডিসেম্বর বুধবার ছিল বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক বেদনার্ত দিন ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। দিনটিতে নানা আয়োজনে স্মরণ করা হলো সেসব মেধাবী মানুষদের। রাজধানীজুড়ে নানান আনুষ্ঠানিকতায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি নিবেদন করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশিষ্টজনের আলোচনায়, সেলুলয়েডের পর্দায়, কবিতার ছন্দে, নাটকের সংলাপে কিংবা শিল্পীর মননআশ্রিত শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব সূর্য সন্তানদের জানানো হয় হৃদয়ের ভালবাসা। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ছিল আলোচনানুষ্ঠান। এতে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ইউরোপের রেনেসাঁ আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সব পট পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই জন্য পরাজয় নিশ্চিত জেনেই পাকিস্তানী শাসক বাঙালীদের মেধাশূন্য করতে সুপরিকল্পিতভাবে আত্মসমর্পণের আগে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের। জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের সচিব শওকত নবী। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে চলছে সপ্তাহব্যাপী ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক উৎসব। যার পঞ্চম দিন বুধবার জাদুঘর প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুস সালামের কন্যা সালমা নার্গিস ও শহীদ প্যারী মোহন আদিত্যের ছেলে নট কিশোর আদিত্য অনুভূতি প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করবে স্রোত আবৃত্তি সংসদ। মাহফুজ রিজভীর গ্রন্থনা ও পরিচালনায় দলটি পরিবেশন করে ‘আমাকে স্মরণ দাও’ শীর্ষক দলীয় আবৃত্তি। বধ্যভূমির সন্তানদল গেয়ে শোনায় ‘ধন্য ধান্য পুষ্পভরা’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘আমাদের পতাকা’ ও ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’। সবশেষে ছিল ছায়ানটের দলীয় পরিবেশনা। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে সঙ্গীতাঙ্গন মনিপুর, ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুল, ঝিনুক শিশু-কিশোর সংগঠন, কালের উচ্চারণ, মূর্ছনা সঙ্গীত একাডেমি, ঋদ্ধস্বর আবৃত্তি একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, গমক সঙ্গীত একাডেমি ও ঘুঙ্গুর সাংস্কৃতিক একাডেমি। বাংলা একাডেমির আয়োজনে নজরুল মঞ্চে বুধবার বিকেলে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। ‘বুদ্ধিজীবীর দায় ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক এএম মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল এবং অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচকবৃন্দ বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশে পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে নাসিরনগর ও গোবিন্দগঞ্জে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায়।‘ঐক্য গড়ো বাংলাদেশ/সাম্প্রদায়িকতা হবে শেষ’- প্রতিপাদ্যে মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দ্বিতীয় দিনের আয়োজন ছিল বুধবার রাজধানীর পাঁচটি মঞ্চে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মঞ্চে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে ভিন্নধারা, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমি ও ছায়ানট। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন ফকির আলমগীর, বুলবুল মহলানবীশ, সমর বড়ুয়া ও আব্দুল ওয়াদুদ। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে প্রকাশ ও কণ্ঠশীলন। একক আবৃত্তি করেন ফয়জুল আলম পাপ্পু, মজুমদার বিপ্লব, মোখলেসুর রহমান প্রামাণিক ও তানভীর হাকিম। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র। পথনাটক মঞ্চস্থ করে নাট্যযোদ্ধা। এছাড়াও কল্পরেখা ও সপ্তকলির আসরের শিশুরা সাংস্কৃতিক পরিবেশন করে। রবীন্দ্র সরোবর কবি রফিক আজাদ মঞ্চে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সুরধ্বনি ও ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন রোকাইয়া হাসিনা, আব্দুল হালিম খান ও সানজিদা মঞ্জুরুল হ্যাপি। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে স্বরব্যঞ্জন, সংবৃতা ও চারুবাক। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন শামসুদ্দোহা, সুপ্রভা সেবতি ও জালাল উদ্দীন হিরা। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ভোরের পাখি নৃত্যকলা কেন্দ্র। লোক নাট্যদল (টিএসসি) মঞ্চস্থ করে পথনাটক। নুপুর একাডেমি ও ঋদ্ধস্বরের শিশুরা সাংস্কৃতিক পরিবেশন করেন। রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ মঞ্চে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা ও কৃষ্টি চর্চা কেন্দ্র। একক সঙ্গীত সাংস্কৃতিক পরিবেশন করেন সুমন চৌধুরী, আবিদা রহমান সেতু ও শিমুল সাহা। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে উদ্ভাষণ ও কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন তামান্না তিথি, সৈয়দ শহিদুল ইসলাম নাজু ও শামিমা নাসরিন মিতু। বর্ণমালা স্কুল এন্ড কলেজ দনিয়া মঞ্চে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সুরসাগর ললিতকলা একাডেমি, ঢাকা একতা সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও লালন পড়শী একাডেমি। প্যান্টোমাইম পরিবেশন করে জেন্টলম্যান। নাট্যদল মঞ্চত্ব করে পথনাটক ‘পতাকা’। মিরপুরের খোন্দকার নূরুল আলম মঞ্চে পথনাটক মঞ্চত্ব করে প্রভাত ও অবয়ব। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে মিথষ্ক্রিয়া আবৃত্তি পরিষদ। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে সঙ্গীত সরণি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন সাফিয়া খন্দকার রেখা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শাহ্জামান তোতা, শাহিনুর রহমান, অনুপমা সরকার ও তুষার চন্দন। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে ছিল আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিসচিব আক্তারী মমতাজ। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচক ছিলেন শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেনের ছেলেন শাহীন রেজা নূর ও শহীদ ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী শোভন। সাংস্কৃতিক আয়োজনে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ঢাকা মহানগর শাখার শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘লাখো লাখো শহীদের রক্ত মাখা’, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’, সেমন্তী মঞ্জরী ও মুস্তাফিজুর রহমান তূর্য গেয়ে শোনান ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘ব্ল্যাক আউটের পূর্ণিমায়’। ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতা আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ইশরাত জাহান বিথী গেয়ে শোনায় ‘মরণ সাগর পারে তোমরা অমর’, ঢাকা সাংস্কৃতিক দল সমবেত কণ্ঠে শোনায় ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’, ‘ভেবো নাগো মা’ ও ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’। একক আবৃত্তি করেন ঝর্ণা সরকার, বেলায়েত হোসেন ও আশরাফুল আলম। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাট্যকেন্দ্রের প্রযোজনায় নাটক ‘বন্দুক যুদ্ধ’। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আলোচনা ও নাটক মঞ্চায়ন হয় উত্তরার স্কিটি অডিটরিয়ামে বুধবার সন্ধ্যায়। গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। আলোচনা শেষে থিয়েটার অঙ্গনের দশম প্রযোজনা ‘মুনীর চৌধুরী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাটকে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর জীবন এবং কর্মের নানা দিক তুলে ধরা হয়। নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছে প্রবীর দত্ত। নাটকের প্রধান চরিত্র মুনির চৌধুরীর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাহবুব আমিন মিঠু। আরও অভিনয় করেছেন সাবিনা আক্তার, মোঃ রাজীব আহমেদ, মোঃ জয় আক্তার সজিব, সম্বিতা রায়, জান্নাতুল ফেরদৌস রশনি, মির্জা সাইফুল ইসলাম সুমন, অক্ষয় কুমার সরকার, মোঃ আলম, সিরাজুল ইসলাম, আজিম আহমেদ সালমান ও মোঃ আবু উবায়দা।
×