ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋতুর পালাবদলে এলো শীত

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে...

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে...

সমুদ্র হক ॥ দিন কয়েক আগেও দুয়ারে কড়া নাড়ছিল শীত। এখন আর শব্দ করে নয়, একেবারে ঠকঠক কাঁপুনি দিয়েই ঘটেছে শীতের আগমন। হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলের একেবারে উত্তরের জেলাগুলোতে শীত এসেছে কিছুটা আগেই। হিমেল হাওয়ায় শীত তরঙ্গায়িত হয় একটু একটু করে। এখন একেবারে অধিকার নিয়ে দুয়ার খুলেই শীতের প্রবেশ। বাঙালীর জীবনে ঋতু বদলের অনেক রূপ আছে। শীতের রূপ বদলে দেয় কুয়াশা। সঙ্গী হয়ে আসে শিশির। ঢাকা মহানগরীতে কংক্রিটের বনে আলো ঝলমলে রাতে কুয়াশা ততটা দৃষ্টিতে আসে না। সন্ধ্যার পর মোটরগাড়ির বডি ও উইন্ডশিল্ডে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করলে বোঝা যায় শিশিরের ঘনত্ব। গ্রামের দৃশ্য একেবারেই পাল্টে যায়। এ সময়টায় সকাল-সন্ধ্যায় ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চরাচর। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ঋতু বদলের যে বৈচিত্র্য মহানগরীতে কৃত্রিমতার মধ্যে তার প্রকাশ যৎসামান্য। প্রতিনিয়ত অপসারিত নিসর্গের শ্যামলিমায় মহানগরীর কান্না শুধু ভেসে বেড়ায়। গ্রীষ্ম ও শীত ছাড়া অন্য ঋতুগুলো যে কখন আসে কখন চলে যায়, তা বোঝাই যায় না। অবশ্য জানার চেষ্টাও করা হয় না। ঢাকা মহানগরীতে শীত একটু দেরিতেই আসে। আর যখন আসে তখন বরফের হাওয়ায় কেঁপেই আসে। আর গ্রামাঞ্চলে শীত জড়িয়ে ধরে হাড়কাঁপুনি দিয়েই। প্রবাদে আছে মাঘের শীতে বাঘ পালায়। বর্তমানে শীতের বাই প্রোডাক্ট শৈত্যপ্রবাহে মানুষ পালিয়ে ঘরবন্দী হয়ে থাকে। নদী তীরবর্তী ও চরগ্রামের মানুষ পালিয়ে আসে অধিক জনঘনত্বের শহরে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধুলোবালির এতটাই আধিক্য যে, ধুলোমেঘের সৃষ্টি হয়ে সূর্যের আলো উর্ধাকাশ থেকে সহজে নামতে পারছে না। এখন ভর বছর মাঠে ধানসহ নানান ফসল থাকায় আকাশে ধুলোর অস্তরন জমছে। ডিসেম্বরের মধ্যভাগে তা পূর্বদিক থেকে আসতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে উল্টো পথে ঘুরে যায়। শৈত্যপ্রবাহের অন্যতম কারণ এই ধুলোমেঘ। বিশ্ব পরিবেশ বিজ্ঞান সমিতি ও ভারতের যৌথ গবেষণায় এমন প্রমাণ মিলেছে। শীতের সময়টায় সন্ধ্যা খুব দ্রুত চলে আসে। বিকাল ও সন্ধ্যার ব্যবধান এতটাই কম যে দিনের দ্বিতীয় ভাগ প্রথম ভাগের চেয়ে সঙ্কুচিত। নগর জীবনে ঋতুর পরিবর্তন এইটুকুই। গ্রামে শীতের আগমন নগরীর জৌলুস থেকে অনেক দূরে। বর্তমানে গ্রামেও শহরের আঁচ পড়েছে। কুঁড়েঘর নেই। অট্টালিকা ও টিনের চালায় ইটের ঘরে গ্রামীণ জীবন আপগ্রেড হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা আকাশে কুয়াশার ঘনঘোর। শরীরে স্পর্শ করে হিমেল হাওয়া। গাছের শাখা-প্রশাখা, পথের ধারের জাংলা ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠে ও মাঠের দুর্বাঘাস রাতভর ঝরা শিশিরে ভিজে ওঠে। সেই শিশিরের ফোটায় সকালের মিষ্টি রোদ হীরের কুচির মতো দ্যুতিময় হয়ে ছড়ায় সাত বঙের ছটা দিয়ে। শীতের রাত অনেক বড়। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠানে জ্যোৎ¯œার ¯িœগ্ধ আলোয় গাছগাছালির ছায়া দেখে গা ছমছম করে ওঠে। এমন রাতের স্তব্ধতায় ভিন্ন ধরনের এক অনুভূতি পেয়ে বসে। হিমেল হাওয়ায় দূর থেকে ভেসে আসে বনফুলের সৌরভ। এমন জ্যোৎ¯œায় কেয়া তার সুগন্ধী ছড়াতে বাতাসে উড়ে উড়ে ঢুকে পড়ে কোন বাড়িতে। রাতে কেয়ার সুবাসে মন ভরে যায়। শীতের সকাল সাঁঝে গ্রামের বড়ির উঠানে খড় লতাপাতা জ্বালিয়ে চারধারে বসে ও দাঁড়িয়ে উষ্ণতা নেয়া হয়। আবহমান কাল ধরে আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণ হওয়ার এমন চল গ্রামে আজও আছে। শীতের রূপের অনেক বর্ণনা আছে রবীন্দ্রনাথের গানে ও কবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথ বাংলার অন্য ঋতু নিয়ে যত লিখেছেন সেই তুলনায় শীত নিয়ে লেখা সামান্যই। শীতের ওপর কবিগুরুর জনপ্রিয় কবিতা ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে/তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে। শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা/তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।’ জীবনানন্দের কবিতায় শীতের রূপ ধরা হয়েছে নানানভাবে। যেমন- চালতার পাতা থেকে ঝরে পড়েছে শিশির বিন্দু, স্তব্ধ রাতের অন্ধকারে গাছের শাখায় শিকার ধরতে ওতপেতে আছে পেঁচা, মাকড়সার জালে জমেছে মুক্তোর মতো শিশির বিন্দু। শীতের সন্ধ্যায় কাছের কোথাও থেকে ভেসে আসে শিয়ালদের কোরাস ডাক। শীত এলেই তারা গলা সাধে। শুনতে ভালই লাগে। বাংলার প্রবাদে শিয়াল প-িত উপাধি অনেক আগেই পেয়েছে। তবে শিয়াল ধূর্ত ও চতুর বুদ্ধিমান নয়। শিয়ালদের শীতকালটা ভালই যায়। ডানা ঝাপটে নৈশ অভিসারে যাত্রা শুরু করে বাদুরের ঝাঁক। এঁকেবেঁকে যাওয়া কোন নদীর মন্থর স্রোতে ঝিলমিল করে ওঠা কুয়াশার ভিতরে দূর দিগন্তে ডুবতে থাকা সূর্যের ম্লান আলো নিসর্গের আরেক রূপ হয়ে ধরা দেয়। প্রকৃতি শীতের শুষ্ক রুক্ষতার অপবাদ ঘোচাতে ফুলগুলোকে সাজিয়ে দেয়। বিচিত্র রঙের গাঁদা মল্লিকা, গোলাপ, ডালিয়া, যেন জৌলুস ফিরে পেতে শুরু করে। ফুলের কমনীয় রঙটি শীতেই পাওয়া যায়, যা টেনে নিয়ে যায় বসন্তের দিকে।
×