ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরদার সিরাজুল ইসলাম

বুদ্ধিজীবী হত্যা, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও সাংবিধানিক দায়

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

বুদ্ধিজীবী হত্যা, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও সাংবিধানিক দায়

’৭১-এর ঘাতক বিএনপি নেতা কুখ্যাত সাকা চৌধুরী এবং জামায়াতের আইকন, বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক মুজাহিদের শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে এক মঞ্চে প্রায় একই সময় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এরা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত হয়ত ক্ষমা পাবে। সেজন্য তারা রাষ্ট্রপতির কাছে ’৭১-এর অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু তাদের অপরাধ এত জঘন্য যে, তাদের ক্ষমা করার এখতিয়ার এ রাষ্ট্রের নেই। এই বিচার কার্যে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দিয়ে শেখ হাসিনা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করলেন এবং প্রমাণ করলেন যে, এ বিচার সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই স্বচ্ছ। উল্লেখ্য, ন্যুরেমবার্গ খ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রায়ালে আপীলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। বিচারপ্রক্রিয়া তথা মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে মাত্র ১৬ দিনে। বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এই বিচার বন্ধ এবং আসামিদের ছেড়ে দেয়ার জন্য অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা মাথা নত করেননি। সাকা চৌধুরী ভেবেছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে অতীতে (ব্রিটিশ আমলে) তার পিতার সঙ্গে যে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল সেই সূত্রে হয়ত তাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে এসবের কোন মূল্য নেই। আরেক রাজাকার নিজামীর মৃত্যুদ-ও কার্যকর হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজামীও উচ্চ আদালতে মৃত্যুদ-ের সাজা হ্রাস করার আবেদন জানিয়ে বস্তুত স্বীকার করেছিল যে, তারা ’৭১ এ গণহত্যায় হানাদার বাহিনীকে মদদ জুগিয়েছে এবং তারা নিজেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। ১৯৭১ সাল বাঙালী জাতির স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের বছর। এর নগদ দাম: জীবনদান-রক্ত এবং মা-বোনের ইজ্জত। বাঙালী স্বাধীন ছিল না কখনও। বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু রক্ত চেয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য। শেষে মুজিব পেরেছিলেন। সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালী সাড়া দিল। ঘোষিত হলো স্বাধীনতা। বিতাড়িত করে পাকিস্তান হানাদার বাহীনিকে; যারা আমাদের সহায়-সম্পত্তি লুট করেছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিরা পারেনি। লজ্জাজনক পরাজয় স্বীকার করেছে ১৯৭১ সালের ষোলই ডিসেম্বর। বাঙালী একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে এ কাজটি করেছিল, অবশ্য সহযোগী হিসেবে পেয়েছিল মহান ভারতকে। এই গণযুদ্ধে সবাই শরিক হয়নি; যারা হয়নি তারা বাঙালী নয়, ওরা রাজাকার-আলবদর যেন ভিনদেশী। ছিল এই ভূখ-ে, কিন্তু ঠিকানা পাকিস্তান। ওরা মাওলানা মওদুদীর অনুসারী। অথবা আইয়ুবের পা-চাটা ভৃত্য। আইয়ুব খানের সৃষ্ট এদেশে ৪০ হাজার ব্যাসিক ডেমোক্র্যাট এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই ছিল বংশগতভাবে মূল আলবদর-রাজাকার। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, এলডিএফ বিরোধিতা করলেও কেবল জামায়াত দলগতভাবে পাক সহযোগী সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রথমে রাজাকার পরে আলবদর নাম নিয়ে সশস্ত্র হয়। বেতন ছিল। গেজেটে নাম আসে। বাংলাদেশে পাকবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার সিংহভাগ ছিল এদের কারণে। পাকবাহিনী পথ-ঘাট চিনত না, তাই দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদররা মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিসেনা তাদের ভাষায় জয় বাংলা ও মুজিবের অনুসারীদের ‘কাফের’ মেরে বেহেস্তে যাওয়ার জন্য গাজী বা শহীদ হওয়ার উৎফুল্ল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ইতিহাস সচেতন সবাই জানেন পাকিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে দুই মাস একটু লম্ফ দিয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বরে এসে প্রায় অন্তিমশয্যা গ্রহণ করে। পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করলে ভারত এই অঞ্চলে পাল্টা আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর ওপর। এতে একেবারে কাবু হয়ে পড়ে কয়েক ঘণ্টায়। ওরা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-গণচীনের সহযোগিতায় যুদ্ধবিরতি এমনকি পাক কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে আলোচনার চেষ্টা করে। কিন্তু মার্কিন সপ্তম নৌবহরের তামাসা এবং চীনের ধাপ্পা অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর সুদৃঢ় নজীরবিহীন ডিপ্লোম্যাসি পাকদের আত্মসমর্পণ ব্যতীত আর কিছুই করার ছিল না। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতির পর ক্যান্টনমেন্ট বাদে ১০ তারিখের মধ্যে প্রায় সব পাকবাহিনী ঢাকার দিকে পালায়। ১০ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা ছিল বলতে গেলে অবরুদ্ধ। পাকি এবং শীর্ষ দালালরা প্রাণভয়ে আতঙ্কিত। ১০ ডিসেম্বর মিত্র ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টারে রায়পুরায় অবতরণ করে। ১১ তারিখে মিত্র বাহিনীর ৭শ’ সেনা মধুপুর এলাকায় এবং ভারতীয় ৫ ব্যাটালিয়ন এবং জেনারেল নাগরা বাহিনীর টাঙ্গাইলে অবস্থানের পরে পাকিদের পালাবার কোন পথ ছিল না। ১৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর গবর্নর হাউসে বোমাবর্ষণ করলে ভয়ে আতঙ্কিত গবর্নর ডাক্তার মালেক তার মন্ত্রিসভাসহ পদত্যাগ করে শেরাটন হোটেলে আশ্রয় নেয়। পাকি জেনারেল নিয়াজীও প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আর ইয়াহিয়া ১ লিটারের একটি মদের বোতল নিয়ে মত্ত হয়ে হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার জন্য (পূর্ব পাকিস্তান নয়) প্রলাপ বকছিলেন। বাঙালীর বিজয়ে নিশ্চিত হয়ে পাকদোসর জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ তখন আলবদর (এখন শিবির) বাহিনী চালিয়েছিল এক জঘন্য নরহত্যা এই ঢাকায়। জামায়াত একটি তালিকা বানিয়েছিল সমাজের বুদ্ধিজীবী হত্যার। ঢাকায় তখন কারফিউ। ১৩ ডিসেম্বর ওদের ছিল ইপিআরটিসির কাদা মাখানো একটি মাইক্রোবাস। নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে স্বজনদের সামনেই ‘আমাদের সঙ্গে একটু যেতে হবে স্যার’ বলে সেই যে নিয়ে গেল প্রথমে মোহাম্মদপুরে আলবদর হেড কোয়ার্টারে, সেখান থেকে গভীর রাতে (১৪ ডিসেম্বর) রায়েরবাজার ‘বধ্যভূমি’ এলাকায় হত্যা করার পরে মরদেহ শনাক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর। এসব বরেণ্য ব্যক্তি হলেনÑ অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বী, ডাঃ মোহাম্মদ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান। শহীদুল্লা কায়সারের লাশ শনাক্ত হয়নি বিধায় তার ভাই জহির রায়হান ৩০.১২.৭১-এ মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে নিজেও নিখোঁজ হন। ডাঃ আলীম চৌধুরীকে (চক্ষু চিকিৎসক) ধরিয়ে দেয়ায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন মাওলানা মান্নান। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭২ সালের দালাল আইনে রাজাকার-আলবদরসহ পাকবাহিনীর সহযোগীদের বন্দী করা হয়। সাপ্তাহিক অর্থনীতি ১৮ ডিসেম্বর ’৮৮ সংখ্যায় প্রকাশÑ ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ওই আইনের অধীনে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে বন্দী করা হয়েছিল এবং একই সময় পর্যন্ত বিচার হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। যার মধ্যে দ-প্রাপ্ত হয় ৭৫২ জন। অনেকের ফাঁসির হুকুমও হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমায় (সাধারণ ক্ষমায় যা খুন, ধর্ষণ, লুটেরার জন্য ছিল না) মুক্তিলাভ করেছিল ৩৬,৪০০ দালাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১/১২/৭৩ ইং তারিখে এ তথ্য প্রকাশ করেন (ফ্যাক্টস এ্যান্ড ডকুমেন্ট-বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- পৃ. ৫০)। মওদুদ আহমদের ‘বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ গ্রন্থের ইংরেজী ভার্সন পৃষ্ঠা ৪৮-৫০ উল্লেখ রয়েছে যে, দালাল আইনে আটক হয়েছিল মশিউর রহমান জাদু মিয়া (আগস্ট ’৭৩), এ.টি মৃধা (মে ’৭৩), জবেদ আলী, মোহাম্মদ হোসেন, লুৎফুল মৃধা, আবদুর রহমান বকুল (আগস্ট ’৭৩), একেএম নাজমুল হুদা, হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ নুরুদ্দিন (আগস্ট ’৭৩) প্রমুখ। পাকবাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। এছাড়া ছিল অবাঙালী নাগরিক যারা পাকিস্তানে যেতে চায়। তারা এখনও আছে। বঙ্গবন্ধু সরকার এদের মধ্যে থেকে ১৯৫ জনকে তদন্ত শেষে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শনাক্ত করে। ১৭.৪.৭৩ তারিখে দিল্লীতে ঢাকা-দিল্লী যৌথ ঘোষণায় এদের বিচার হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৭ এপ্রিল দিল্লী থেকে ঢাকায় এসে বিবৃতি প্রদান করেন। কিন্তু এই ইশতেহার প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকা পাকিস্তানের একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করে, ‘বাংলাদেশ যদি যুদ্ধবন্দীদের ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য বিচার করে তবে পাকিস্তানে সমসংখ্যক উর্ধতন বাঙালী সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তার বিচার হবে।’ অথচ তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী নয়। কেবল তারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চেয়েছে এই অপরাধে তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রতিশোধমূলক বিচারের পাঁয়তারা করেছিল ভুট্টো। উল্লেখ্য, সঠিক তথ্য না থাকলেও পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালী কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সামরিক বাহিনীতে ২৬ হাজার এবং বেসামরিক কয়েক লাখ (বিচিত্রা ২৭/৪/৭৩)। তবে জুলফিকার আলী ভুট্টো ওয়াদা করেছিলেন যে, ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার তারা করবেন। অথচ টিক্কা খানকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঠিক সংখ্যা কত ছিল তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে বন্দী করার পরেও বেশকিছু রাজাকার আত্মগোপন করেছিল। বৈরী বাস্তবতার ফলে রাজাকার-আলবদরদের আটক করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়া দালাল আইন সব উঠিয়ে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী, খুনী-আলবদর-রাজাকার সবাইকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। যা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জামায়াতকে শক্তিশালী করার পথ করে দেয়। এমনকি ২০০১ সালে ২ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতি নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী করেছিলেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচন করলেন জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে এবং সরকার গঠন করলেন তাদের ৩টি মহিলা আসন দিয়ে। জামায়াত এবং বিএনপি এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। আজকের ’৭১-এর ঘাতকদের মুক্তির জন্য খালেদা জিয়া দাবি জানিয়েছিলেন। সাকার ফাঁসির পরে তারা শোকার্ত হয়ে বলেছিলেন যে, সাকা একজন ভাল মানুষ ছিল। আর মুজাহিদের জন্য তাদের ব্যথা প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাননি। যাই হোক, যুদ্ধাপরাধীর বিচারে শেখ হাসিনা সকল রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে নির্ভয়ে এগিয়ে চলেছেন। এ কারণেও বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর মধ্যে তাঁর অবস্থান ১৩তম। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×