ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীরা আর্থিকভাবে ভাল নেই ॥ আবদুল জব্বার

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

শিল্পীরা আর্থিকভাবে ভাল নেই ॥ আবদুল জব্বার

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শিল্পী আবদুল জব্বার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের, সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। তাঁর দেখা এ সময়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে কথা হয় গুণী এই শিল্পীর সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে যেমন দেখেছেন... আবদুল জব্বার : পাকিস্তানী শাষকদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন দোসর ছাড়া মূলত এ সময় বাঙালীদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। এখন সেগুলো শুধুমাত্র নির্বাক স্মৃতি। অনেক জায়গায় রাজাকারদের সহায়তায় ঘর থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। খুন, ধর্ষণ আর লুট-পাটের মধ্যে দেশের অসহায় মানুষের আর্তনাদ চোখে না দেখলে সেই দিনগুলোর কথা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সে সময় বিভিন্ন সেক্টরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার ছিল তার মধ্যে একটি সেক্টর। আমরা গণসঙ্গীত দিয়ে সারা বাংলাদেশের মানুষদের উজ্জীবিত করেছিলাম। আপনাদের কার্যক্রম কি ছিল? আবদুল জব্বার : আমরা দেশ স্বাধীনের জন্য যে যেভাবে পারি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম গান আমার গাওয়া ছিল। ‘অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা দেব যে আরও এ জীবন পণ’ শিরোনামের গানটি লিখেছিলেন টিএইচ সিকদার এবং আমি নিজেই সুর করেছিলাম। ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ নামে একটি সংগঠন করেছিলাম। সংগঠনটি নিয়ে বোম্বে পর্যন্ত গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করি। আমরা যখন দেশবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গানের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করি তখন আমাদের সঙ্গে যোগ দেন ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখার্জী, মান্না দে, সলিল চৌধুরীসহ আরও অনেকে। আমরা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে ১২ লাখ ভারতীয় মুদ্রা পেয়েছিলাম। সেগুলো মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে জমা দিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনারা কীভাবে যোদ্ধাদের সাহস যোগাতেন আবদুল জব্বার : আমরা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষদের গণসঙ্গীত গেয়ে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি বালিগঞ্জের যে বাড়িতে অবস্থিত ছিল আমরা সেই বাড়িতেই ফ্লোরিং করতাম। বেতারে একটি গান গেয়ে পেতাম ৩০ রুপী। আমাদের থাকা-খাওয়া সব কিছুতেই খুব কষ্টের মধ্যে কাটাতে হতো। কিন্তু মনের মধ্যে ছিল দেশ স্বাধীন করার অদম্য ইচ্ছা ও সাহস। যার ফলে কোন কষ্টই আমাদের কাছে কষ্ট মনে হতো না। তখন যে চেতনা ও আন্তরিকতা নিয়ে স্বল্প পরিসরে আমরা গান করতাম, পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে আর সে রকম অনুভূতি আসেনি। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী হিসেবে আপনি কি ভাবছেন? আবদুল জব্বার : যে আশা নিয়ে সেদিন যুদ্ধ করেছিলাম এখন আমাদের সে আশা কিছুটা ধুসর হয়ে এসেছে। এখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের মূল্যায়ন কমে গেছে। শিল্পীরা আর্থিকভাবে ভাল নেই। আমাদের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের তফাৎ অনেক। একটি স্বাধীন ভূখ-ের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যাশা ছিল দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীন একটি ভূখ-ই আমাদের প্রাপ্য হলেও তাও এখন হুমকির মুখে। আমরা এখনও আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। বঙ্গন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। দেশ স্বাধীনের পর যখন মহাধুমধামে ১৬ ডিসেম্বর উদ্যাপন করছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোরা কি স্বাধীনতা রাখতে পারবি?’ তখন সে অনুভব আমাদের ছিল না। এখন বুঝতে পারি এই মহাপুরুষ কত বড় গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তবে অন্ধকারের পরে যেমন আলো আসে তেমনি আলোর মুখ দেখতে পাব আমরা। আমাদের স্বাধীনতার জন্য আর একটা যুদ্ধ করতে হবে। -গৌতম পাণ্ডে
×