ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমার খবর কেউ রাখে না ॥ সুব্রত সেনগুপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

আমার খবর কেউ রাখে না ॥ সুব্রত সেনগুপ্ত

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত সেনগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি, নিজের লেখা গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সংগঠিত করেছিলেন লাখ লাখ শরণার্থীসহ সাধারণ মানুষদের। ক্যান্সারে আক্রান্ত এই শিল্পী দীর্ঘদিন অসুস্থ। বিছানায় শুয়ে দেশের মানুষের জন্য নিরন্তর গান লিখে চলেছেন। তার দেখা সে সময়ের ঘটনাবলী এবং আজকের বাংলাদেশ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন? সুব্রত সেনগুপ্ত ॥ আমি ১৬ বছর ধরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, এখন ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। আমার খবর কেউ রাখে না। আমার চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন, এত অর্থের যোগন আমার পরিবার থেকে দেয়া সম্ভব নয়। এতদিন বিভিন্ন সময়ে শরীর যখন খুব খারাপ হয়ে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে, এখন আর কোন টাকা-পয়সা আমার নেই। সরকারের কাছে আমার প্রার্থনা, যদি সদয় হয়ে আমার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসে, তাহলে হয়ত বাঁচতে পারব। আমার কষ্ট হয়, দেশের জন্য এত কিছু করেছি, নিজের জীবন বাজি রেখেছি, আজ আমার নির্মম কষ্ট সহ্য করে হয়ত এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে যেমন দেখেছেন? সুব্রত সেনগুপ্ত ॥ আমি আত্মীয়তার সূত্রে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাতি। কাজেই বিপ্লবী রক্ত আমার ভেতরও প্রবাহিত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকার সেগুন বাগিচায় ওস্তাদ বারিণ মজুমদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমার ভেতর সেই বিল্পবী চেতনা আরও উদ্দীপ্ত হয়। ২৫ মার্চে রাতে যখন পাক সেনারা ঢাকাসহ সারাদেশে খুন-জালাও-পোড়াও শুরু করে। আমার সহপাঠীসহ শ্রদ্ধেয় কয়েকজন শিক্ষক বিদ্যালয়ের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ২৬ মার্চে খুব কষ্টে সেখান থেকে বাইরে এসে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মৃত লাশ দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু সাহস নিয়ে বিভিন্ন কৌশলে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকি। আমি পাগলের বেশে বিভিন্ন জায়গার খবর ও বোমা বহন করতাম। বেশ কিছুদিন ধরে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কায়দায় লড়ে যেতে লাগলাম। পরে যখন দেখলাম তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না, তখন ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কমলাপুর রেল স্টেশনে এসে দেখলাম একটি ট্রেন মানুষের রক্তে ভেজা এবং অসংখ্য মৃতদেহ। চোখের জল আর রাখতে পারলাম না। ভয়ও পেলাম। অনেক কষ্টে কসবা বর্ডার দিয়ে পার হয়ে ভারতের সোনামুড়ায় পৌঁছিয়ে আগরতলা শহরের কংগ্রেস ভবনে উঠলাম। সেখান থেকে কিভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দিলেন? সুব্রত সেনগুপ্ত ॥ কংগ্রেস ভবনে এসে অনেক পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলো। সেখান থেকে বলা হলো যে বিষয়ে যে পারদর্শী সে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আমার আছে সুর, গান লেখার ক্ষমতা। স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করলাম। কলেজ টিলায় পৌঁছিয়ে নৃত্য পরিচালক আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা হলো, ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কলকাতা ১৯’র ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছলাম। সেখানে আপনাদের কার্যক্রম কি ছিল? সুব্রত সেনগুপ্ত ॥ সেখানে গান লেখা ও সুর করা হতো এবং সবাই রিহার্সাল করে গানগুলো রেকর্ড করতাম, পরে সেগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হতো। আমি অনেক গান এবং কবিতাও লিখেছি। আমার লেখা ‘রক্ত চাই রক্ত চাই অত্যাচারীর রক্ত চাই’ গানটির সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, ‘ছুটরে সবাই বাঁধ ভাঙা বান অগণিত গ্রাম মজুর কিষান’ গানটির সুর করেছিলেন অনুপ ভট্টাচার্য, ‘শোন জনতা গণজনতা’ গানটি সুর করেছিলেন সলীল চৌধুরী। এছাড়া আমি কবিতও লিখতাম। যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীন দেশে এখন তার বাস্তবায়ন কতটুকু? সুব্রত সেনগুপ্ত ॥ আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম তা পুরোটা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখন পরাজিত শত্রুরা আবার নতুন করে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টায় লিপ্ত। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠসৈনিক হিসেবে দীর্ঘদিনের অসুস্থতা নিয়েও আমার কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছি। সেখান থেকে লিখে যাচ্ছি গান, আমার এ গান মানুষ শুনতে পাবে কিনা জানি না, কিন্তু আমার দ্বায়বদ্ধতা থেকে লিখেই চলেছি। নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান তারা যেন আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে শেখে, তাহলে হয়ত একদিন আমাদের সে আশা পূর্ণ হবে। -গৌতম পাণ্ডে
×