ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীলুফার বেগম

স্মরণ ॥ অনন্তলোকে শুভ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬

স্মরণ ॥  অনন্তলোকে শুভ

আমাদের প্রাণপ্রিয় শুভ হারিয়ে গেছে অনন্তলোকে। যার পোশাকি নাম ছিল ড. জালাল আলমগীর। সে ছিল আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বড় ছেলে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শেষ করে দিতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর অস্ত্র ও বোমার আঘাত হানছে যখন, তখন করাচি থেকে বদলি হয়ে দেশে এলো মাসখানেকের ছোট্ট শুভকে নিয়ে আমার ভাই আলমগীর ও তার স্ত্রী সিতারা। ঢাকায় শুভ বড় হয়ে উঠল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হলো। এরপর সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে পড়া শেষ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলো। ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে নিউইয়র্কের সেন্ট লরেন্স ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেল; ওখানে গ্র্যাজুয়েশন শেষে মাস্টার্স ও পিএইচডি করল ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে। শুভ (ড. জালাল) ছিল বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক। তাছাড়া শীর্ষস্থানীয় গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল মনেপ্রাণে। তার কাজের গভীরতা ও ব্যাপ্তির পরিচয় পাওয়া যায় উইকিপিডিয়ায় তার নাম সার্চ করলে। শুভর প্রথম বইয়ের বিষয় ছিল ভারত আর প্রকাশক হলো রাটলেজ। বইয়ের শিরোনাম ইনডিয়াস ওপেন ইকোনমি পলিসি : গ্লোবালাইজম, রাইভেলারি, কনটিনিউটি। এটি বিশ্বায়ন ও গণতন্ত্রের ওপর অনুসন্ধানমূলক বই। বইটি এ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ান স্টাডিজ আনন্দ কেন্তিশ কুমার স্বামী বুক প্রাইজের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। এই বইটি আকর্ষণ করে পাঠক মহলের। ২০০৮ সালে পলিসি মেকার লাইব্রেরিতে এশিয়া পলিসি অন্তর্ভুক্ত করে বইটি। অধ্যাপনা, লেখালেখি ও গবেষণা সম্পৃক্ত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও শুভ পরিবার ও দেশকে ভোলেনি। ২০০৭ সালে তার পিতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আটক করায় সে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল পত্র-পত্রিকায়। এখনও যা আমাদের মনে দাগ কেটে আছে। শুভ ছিল অতীব সৃজনশীল মেধাবী ছেলে। পারিবারিক পরিচয়ের বাইরেও তার পরিচয়ের ব্যাপ্তি ছিল অনেক। যার জন্য আমেরিকায় বাংলাদেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের কাছে ছিল সে অত্যন্ত সুপরিচিত। মনে পড়ে আমার প্রকাশিত বই ‘আমার গল্পের ভুবন’ তার হাতে দিলাম তাদের বনানীর বাসায় গিয়ে। বইটি হাতে নিয়ে বলল, ‘ফুফু আগামী জানুয়ারিতে আমার একটি গল্পের বই বের হবে, তবে তা ইংরেজী ভাষায়।’ ২০১১তে নয় মাসের শিক্ষা ছুটিতে সে দেশে এসেছিল আর যুক্ত হয়েছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গবর্নেন্স স্টাডিজের সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার ওপর তুলনামূলক গবেষণা করা। বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে শুভ অংশ নিয়েছে, বিশেষ করে এ ব্যাপারে চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ্য। যেখানে পিতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ ড. জালাল আলমগীর অংশ নিয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে ও দেখে পরিচিত অনেকেই টেলিফোন করেছিল আমাকে। এছাড়া সে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছিল। ১৩ মে, ২০১১ আমার ছোট ছেলে তামিমের স্টুডিওর ওপেনিং হয়েছিল। শুভ পেইন্টিং আঁকা ছবি ভালবাসত। প্রচারবিমুখ ও পরিমিতিবোধসম্পন্ন এই শুভ স্বল্প সময়ের ভেতর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সে শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ও দিল্লীর সেন্টার ফর পলিসি গবেষক ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনিসিয়েটিভের ফেলোও ছিল। এছাড়া আরও অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। তার গবেষণার বিষয়বস্তু বিভিন্ন নাম করা পত্র-পত্রিকা ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রচারবিমুখ ছেলে নিজেকে কখনও বড় করে দেখায়নি। এত অমায়িক ছিল সে। শুভ ভাল সাইকেল চালাতে জানত। একবার বন্ধুদের বিশাল বহর নিয়ে ৮৫ মাইল সাইকিলিং করে চাঁদা তুলে বস্টনের ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে দিয়েছে, সঙ্গে নিজের সেভিংসও ওই ইনস্টিটিউটে দান করেছে। শুভ ভাল গিটার বাজাত। গিটার বাজিয়ে গান গাইত। আযম খানের দেশীয় গান তার পছন্দের ছিল। আযম খানের ‘ও মালেকা ও ছালেকা’ গানটা গিটার বাজিয়ে মাঝে-মধ্যে গাইত। সে গানও লিখত এবং ভাল সাঁতারও জানত। শুভ ২ ডিসেম্বর, ২০১১ থাই এয়ারওয়েজে করে ব্যাঙ্কক যায় স্ত্রীসহ অবকাশ যাপনে। ৩ ডিসেম্বর, ২০১১ শনিবার আমি যাচ্ছি আমাদের বড় ভাই মরহুম ইতিহাসবিদ ও প্রাক্তন সংসদ সদস্য মিসবাহ উদ্দিন খানের ৮২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ধানম-ি ২৭নং রোডে ডব্লিউভি মিলনায়তনে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে শরিক হতে। যানজটের কারণে দেরি হওয়ায় অস্বস্তি বোধ করছি। এমন সময় ভাইপো ড. নাদিম জাহাঙ্গীর টেলিফোনে জানাল শুভ ব্যাঙ্ককে মারা গেছে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার বাবা ড. জাহাঙ্গীর ও চাচা ড. আলমগীরকে যেন সংবাদটি জানাই। এরপর টেলিফোন এলো রাজশাহী থেকে ছোট ভাই ড. আরেফিনের। সে জানাল একই খবর। আমি দিশেহারা অবস্থায় অনুষ্ঠানে পৌঁছলাম। সেখানে বড় ভাইপো ড. মুনতাসীর মামুনকে বললাম এ মর্মান্তিক খবর। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অনুষ্ঠানে যখন ড. আলমগীর সমাপনী ভাষণ শেষ করল তখন তার টেলিফোনে শুভর মৃত্যুর খবর এলো। শুভ ব্যাঙ্কক থেকে এক ঘণ্টা দূরত্বের ফুকেটের সাউথ কোস্ট এলাকায় সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় ওই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। খবর শোনার পর আমরা স্বজন-পরিজন সবাই ড. আলমগীরের বনানীর বাসার দিকে রওনা হলাম। সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সেই স্মৃতি এখনও কাঁদায়। শুভ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে ও অন্তরে শুভ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আর তার লেখালেখি, গবেষণা ও অন্য গুণাবলীর মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত থাকবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিভাবান ব্যক্তি হিসেবে। লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব
×