ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজওয়ানা আলী

বিলিওনিয়ার নারী যারা নিজেদের তৈরি করে

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২ ডিসেম্বর ২০১৬

বিলিওনিয়ার নারী যারা নিজেদের তৈরি করে

পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে অর্থপ্রতিপত্তি পুরুষেরই আধিপত্যে। এটা যে শুধু বাংলাদেশের মতো দেশেই ঘটছে তা না, উন্নত বিশ্বেও এখনও সংসারের খাতিরে মেয়েরা নিজেদের ক্যারিয়ার, উচ্চাকাক্সক্ষা সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ছাড়তে বাধ্য হন। তার মধ্যেই কিছু অদম্য নারী নিজেদের প্রমাণ করেছেন। জায়গা করে নিয়েছেন এমনকি শীর্ষ ধনী-বিলিওনিয়ার ক্লাবেও। নারীর ব্যবসা বলতে বুটিক, রান্না ইত্যাদির প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে অনেকেই নিজেদের প্রমাণ করেছেন ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্রে যেগুলো পুরুষের এলাকা বলে বিবেচিত। যেমন- রিয়েল এস্টেট, প্রযুক্তি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি নয়, বরং নিজের একক চেষ্টায় গড়েছেন বিজনেস এ্যাম্পায়ার। এরা পৃথিবীর সব নারীর জন্যই প্রেরণা। নিচে এমনই কিছু নাম তুলে ধরা হলো। জু কানফেই (চীন) : এই নারী হুনানের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬ বছর বয়সে কাজ নেন ঘড়ির কারখানায়। কর্মদক্ষতার গুণে দ্রুত প্রমোশন পান এবং তিলেতিলে জমিয়ে তোলেন ৩০০০ ডলার। ওই ডলার দিয়ে তিনি আগের চাকরিদাতার প্রতিষ্ঠানের ঠিক পাশেই নিজের লেন্স ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন। তার প্রতিষ্ঠান ‘লেন্স টেকনোলজি’র টার্নিং পয়েন্ট আসে ২০০৩ সালে যখন মটরোলা তাকে তাদের সেলফোনের জন্য প্লাস্টিক স্ক্রিনের বদলে শক্ত কাঁচেরটা করে দেয়ার জন্য অফার দেয়। প্রস্তাবটি লুফে নেন তিনি। এরই পথ ধরে একের পরে এক বিশ্বখ্যাত মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আসে। ২০০৭ সালে এ্যাপলের নির্মিত প্রথম আইফোনের কীবোর্ড টাচস্ক্রিন তৈরিও এর অন্তর্ভুক্ত। টাচস্ক্রিন মডেল ভীষণভাবে জনপ্রিয় হলে লেন্স টেকনোলজি দ্রুত বড় হতে থাকে। এক সময় জু’র নামের আগে লাগে বিলিওনিয়া তকমা। আজ তার ক্রেতার তালিকায় আছে এ্যাপল, স্যামসাংয়ের মতো বিখ্যাত সব নাম। জু’র বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ৬ বিলিয়ন, তার প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য ৭ বিলিয়ন ডলার। চ্যান লাইওয়া (চীন) : তালিকার দ্বিতীয় নামটিও চীনের। ’৪০ থেকে ’৫০ সময়টার মধ্যে চীনে জাপানের আগ্রাসনের অস্থির সময় ছিল চ্যানের বেড়ে ওঠার কাল। মাঞ্চু রাজপরিবারের উত্তরসূরি হলেও চ্যানেরা ছিলেন খুবই দরিদ্র। এতটাই যে হাই স্কুলেই পড়ার ইতি টানতে হয় তাকে। জমানো টাকায় ১৯৭৬ সালে আসবাবপত্র মেরামতির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে হংকং যান এবং ১৯৮০ সালের প্রথমদিকে একডজন ভিলা কিনে বিক্রি করার মাধ্যমে আবাসন ব্যবসায় প্রথম লাভের মুখ দেখেন। বেজিংয়ে ফিরে ১৯৮৮ সালে শুরু করেন রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি-ফু ওয়াহ ইন্টারন্যাশনাল। এই কোম্পানির বিস্তার এখন শুধু চীনে সীমিত নয়- বিস্তৃত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডেও। চ্যানের বর্তমান সম্পত্তির মূল্য ৫.২ বিলিয়ন ডলার। তার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের একটি হচ্ছে চায়না রেড স্যান্ডালউড মিউজিয়াম। ছোটবেলার রেড স্যান্ডলউড নির্মিত আসবাবপত্রের প্রতি ভালবাসা থেকে চ্যান এতে বিনিয়োগ করেন ২৪ মিলিয়ন ডলার যাতে এই ঐতিহ্য রক্ষিত হয়। মিউজিয়ামটি রেড স্যান্ডালউডের সংগ্রহ ও গবেষণার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদুঘর। ফু ওয়াহ ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান- এই পরিচয় ছাড়াও চ্যানের আলাদা আরেকটি পরিচিতি আছে দানশীলতার জন্য। দুর্যোগ মোকাবেলা, সাহায্যকার্যে এ পর্যন্ত চ্যান মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। এলিজাবেথ হোমস (যুক্তরাষ্ট্র) : এলিজাবেথের কাজের ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্যসেবা। ২০০৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্টানফোর্ডের পড়াশোনা ছেড়ে থেরানোস নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি রক্ত পরীক্ষার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা যা হবে ব্যথাবিহীন ও সুঁইবিহীন, একই সঙ্গে রোগীদের মাথাব্যথার কারণ হবে না, খরচও কম থাকবে। সিলিকনভ্যালিভিত্তিক থেরানোস এখন সরাসরি ভোক্তাদের ২৪০টির বেশি টেস্ট করার সুযোগ দেয় যার মধ্যে আছে হাই কোলেস্টেরলের মতো সাধারণ পরীক্ষা থেকে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ পর্যন্ত। গত শরতে তার কোম্পানির বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার এবং এলিজাবেথ নিজে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে বর্তমানে মাত্র ৩২ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী সেলফমেড নারী বিলিয়নিয়ার। অপরাহ উইনফ্রে (যুক্তরাষ্ট্র) : এই তালিকার বাকি নামগুলো তুলনামূলক অপরিচিত হলেও এই নামটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। মিসিসিপির দরিদ্রতার মধ্যে মানুষ অপরাহ মিডিয়াতে আসেন ১৯৭০ সালে টিভি সংবাদ উপস্থাপিকা হিসেবে। কিন্তু তাকে অভাবনীয় পরিচিতি এনে দেয় তার নামে নাম রাখা ‘অপরাহ উইনফ্রে শো’। উপস্থাপনা ছাড়াও চলচ্চিত্রেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন ‘দি কালার পার্পল’ ছবির মাধ্যমে যা তাকে অস্কারের নমিনেশন পাইয়ে দেয়। ১৯৮৬ সালে অপরাহ ‘হাপ’ স্টুডিও’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে ২৫ বছর টকশো উপস্থাপনা করেন যা পিক সময়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয়ের রেকর্ড আছে। তার বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণ ২.৮ বিলিয়ন ডলার। অপরাহর প্রভাবকে শুধু তার অর্জিত টাকার ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা যাবে না। সমাজে তিনি একজন রোল মডেল। যেমন ধরা যাক গেল অক্টোবরের কথা। তিনি জানালেন ওজন কমানোর কোম্পানি ‘ওয়েট ওয়াচারস’ এ ১০% স্টক কিনেছেন। রাতারাতি স্টকের মূল্য দ্বিগুণ হলো। বছরের শুরুতে আরেক মন্তব্যে- তিনি ২৬ পাউন্ড ওজন কমিয়েছেন শোনার পরেও একই স্টকের মূল্য আকাশ ছুঁয়েছিল। জুডি ফকনার (যুক্তরাষ্ট্র) : এপিক সিস্টেমসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জুডি ফকনার টেক বিলিওনিয়ার হিসেবে এই তালিকার সর্বশেষ জন। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জুডির প্রতিষ্ঠান কাজ করে হেলথকেয়ার সফটওয়্যার নিয়ে। ১৯৭৯ সালে ৭৫ হাজার ডলার পেইডআপ ক্যাপিটাল নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন বার্ষিক ২ বিলিয়ন ডলারের সেল করে থাকে। এপিকের ডাটাবেজ প্রায় অর্ধেক আমেরিকানের মেডিক্যাল তথ্য ধারণ করে, গ্রাহক তালিকায় আছে সিভিএস হেলথ, জনস হপকিন্স, কাইজার প্যারামান্টের মতো নাম। জুডি ফকনারের আরেকটি পরিচয় তার দাতব্য ভূমিকা। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটের ‘গিভিং প্লেজ’ ক্যাম্পেনে সাড়া দিয়ে ২০১৫ সালে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের মালিক জুডি অঙ্গীকার করেছেন তার সম্পদের ৯৯% মানবকল্যাণে দান করার ।
×