ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫ জন গ্রেফতার

রাজধানীতে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

রাজধানীতে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীতে আবারও প্রাণঘাতী ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে ঢাকায় অন্তত সাতটি কারখানার সন্ধান পেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নকল ইয়াবা তৈরির বহু কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তেও ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে। সদ্য আবিষ্কৃত হওয়া কারখানাটি থেকে জব্দ হয়েছে পাঁচ শ’ পিস ইয়াবা, যা নকল। গ্রেফতার হয়েছে পাঁচ ইয়াবা ব্যবসায়ী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশে বেচাকেনা হওয়া শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ইয়াবা ট্যাবলেটই নকল, যার অধিকাংশই দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। নকল ইয়াবা উৎপাদনের কারণে আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ টাকায় মিলছে প্রতি পিস ইয়াবা। প্রকৃতপক্ষে প্রতি পিস আসল ইয়াবার বর্তমান বাজার মূল্য অন্তত সাড়ে তিন হাজার টাকা। এসব নকল ইয়াবা সেবনের ফলে সেবনকারীরা কিডনি সংক্রান্ত নানান জটিল রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বুধবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের পূর্ব বিভাগের অভিযানে রাজধানীর মিরপুর-২ নম্বর থেকে গ্রেফতার হয়- ইয়াবা ব্যবসায়ী জসিমউদ্দিন ওরফে শিমুল, সৈয়দ তরিকুল ইসলাম ওরফে সুমন, মোঃ আলী আকবর, জুবায়ের হোসেন জুয়েল ও মোঃ কীর্তি আজাদ ওরফে টুটুল। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ইয়াবা তৈরির কম্প্রেসার, মোটর, ইয়াবা তৈরির উপাদান মিশ্রণের যন্ত্র, স্প্রে মেশিন, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও কেমিক্যালসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্মকমিশনার আব্দুল বাতেন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির উত্তর, দক্ষিণ, মিডিয়া ও পূর্ব বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মাশরুকুর রহমান খালেদ, মাসুদুর রহমান ও খন্দকার নুরুন্নবী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাঁশপট্টির ১২০ নম্বর বাড়িতে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় ডিবি পুলিশ। কারখানায় উৎপাদিত প্রায় ১৩শ’ পিস ইয়াবা, ইয়াবা তৈরির কাঁচামালসহ গ্রেফতার হয় প্রস্তুতকারীদের অন্যতম আলী আকবর (২৮) ও তার সহযোগী সোহেল (৩২), রুবেল (২৪) ও রাজ্জাক (৪৫)। ওই বছরের ২৪ আগস্ট রাজধানীর শুলশানের নিকেতন এলাকা থেকে ইয়াবা তৈরির অত্যাধুনিক কারখানা, ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহৃত পাজেরো জীপসহ গ্রেফতার হয় আব্দুল্লাহ জুবায়ের ও তার তিন সহযোগী। কারখানা থেকে জব্দ হয় ইয়াবা তৈরির সব সরঞ্জাম ও কাঁচামাল। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সারাদেশে নকল ইয়াবা তৈরি ও বেচাকেনা সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর তথ্য। আলী আকবর নিজেই অন্তত ৫ লাখ ইয়াবা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছে বলে স্বীকার করে। আলী আকবর বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি ওষুধ তৈরি কারখানার কেমিস্ট হিসেবে ছিলেন। নকল ওষুধ তৈরির সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে জেলহাজতে যেতে হয়। ২০১২ সালে কারামুক্ত হয়ে নকল ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরি শুরু করে। নকল ইয়াবা তৈরির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে কোন না কোন সময় কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করেছে। আর জুবায়েরের ঢাকায় দুইটি ও চট্টগ্রামে দুইটি এবং কক্সবাজারেও ইয়াবা তৈরির কয়েকটি কারখানা ছিল। সে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তেও ইয়াবা তৈরির কারখান স্থাপনের চেষ্টা করছিল। ডিবির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে বেচাকেনা হওয়া শতকরা নব্বই ভাগ ইয়াবা ট্যাবলেটই নকল। বাংলাদেশের বিভিন্ন ওষুধ কারখানায়ও নকল ইয়াবা তৈরি হয়। মাদকের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করার পর দেশেই ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠতে থাকে। ইয়াবা তৈরির প্রধান উপাদান এমসিটামিন নামের রাসায়নিক পদার্থ। এ পদার্থটি বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি সরকারী অনুমোদন নিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। তাদের হাত ঘুরেই রাসায়নিক পদার্থটি নকল ইয়াবা প্রস্তুতকারীদের হাতে চলে যায়। আবার ওই সব ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট হিসেবে চাকরি করা অনেকেই পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে ইয়াবা তৈরি শুরু করে। কারণ ইয়াবা একটি ওষুধ। হালে দেশে কোন চিকিৎসক রোগীকে ইয়াবা সেবনের অনুমতি দিচ্ছেন না। তবে বিদেশে কোন কোন চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী কোন রোগীকে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের অনুমতি দিয়ে থাকেন। ইয়াবা ট্যাবলেট মূলত ক্ষুদামন্দা ও অধিক ওজনের ব্যক্তিদের হালকা পাতলা করতে চিকিৎসকরা রোগীদের প্রেসক্রাইভ করে থাকেন। তবে ইয়াবা সাধারণত দশ থেকে পনেরো দিনের বেশি কোন রোগীকে সেবন করার অনুমতি দেন না চিকিৎসকরা। আবার দীর্ঘ বিরতির পর আবার রোগীকে প্রয়োজন হলে ইয়াবা সেবনের অনুমতি দিয়ে থাকেন। ইয়াবা এমন একটি ওষুধ যা অনেক দিন সেবন করলে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়েন। এজন্যই চিকিৎসকরা সাধারণত ইদানীং আর ওষুধটি রোগীদের সেবনের জন্য প্রেসক্রাইভ করেন না। সত্যিকারের এমসিটামিন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম পড়বে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। দেশে উৎপাদিত ইয়াবা ট্যাবলেটগুলোতে পরিমাণ মতো এমসিটামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ থাকে না। এর কারণ হচ্ছেÑ মিয়ানমার থেকেও ইদানীং আর আসল ইয়াবা আসছে না। মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও নকল ইয়াবা তৈরি করে বিক্রি করছে। মিয়ানমার থেকে আসার কারণে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী সেটিকে আসল ইয়াবা হিসেবে ধরে নিচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আনা এক শ’ পিস ইয়াবা দিয়ে অন্তত একহাজার পিস ইয়াবা তৈরি করছে। ফলে ইয়াবার যে গন্ধ সেটি থাকছে খুবই কম পরিমাণে। ইয়াবা থেকে দামী বিস্কুটের মতো গন্ধ বের হয়। এক্ষেত্রে দামী বিস্কুট তৈরি করার উপাদান ব্যবহার করছে ইয়াবায়। ফলে ইয়াবাসেবীরা সেটিকে আসল ইয়াবা হিসেবেই ধরে নিচ্ছে। ইয়াবা সেবনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেছেন, এটি এমন একটি ওষুধ যা সেবনে শরীরে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে লিভার, কিডনি, হার্ট ও মস্তিস্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনে মানুষের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। কোন কোন ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে ইয়াবা সেবন করতে না পারলে উত্তেজিত হয়ে মানুষকে হত্যাও করতে পারে। নিজের শরীরে আঘাত করে। ইয়াবার নেশা ভয়ানক উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন, ইয়াবার টাকা যোগাড় করতে অনেক সময়ই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন ইয়াবাসেবীরা।
×