ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২২ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

তৃতীয় অধ্যায় ॥ বাগেরহাটে এক বছর (গতকালের পর) মেলাটি নিয়ে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া ছিল। এরকম মেলা সে সময় ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের অন্যত্র কোথাও হত না, তাই এর নতুনত্ব ছিল প্রশংসনীয়। একটু রক্ষণশীল গোষ্ঠী মনে করেন যে, এত খরচ করে এমন একটি আয়োজন খুব ভাল হলো না। যুব ও তরুণ মহল কিন্তু মেলার জন্য অনেক খাটাখাটি এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে। কিন্তু দু’মাসব্যাপী মেলায় জনসমাবেশ ও আগ্রহ দেখে আমি খুবই তৃপ্তি পাই। একটি মহকুমা শহরে তখন যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হয় তার মান ছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। খান আতা অত্যন্ত সুচারুভাবে নাটক, গান-বাজনা, গীতিনাট্য ইত্যাদি পরিবেশন ও পরিচালনা করেন। মেলাটি সমাপ্ত হবার পরেই আমার বদলির নোটিস আসল। তাই সব কিছু গুটিয়ে নিতে আমার বেশ অসুবিধা হলো। টাকা-পয়সার দিক দিয়ে টানাটানি ছিল না। কারণ যাত্রা, কবিগান, জারিগান, নাট্যানুষ্ঠান এবং গান-বাজনার আসরগুলো থেকে আমরা বেশ আয় করি। এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করতে গেলে টিকেট খরিদ করতে হতো। আমার কোন অমীমাংসিত হিসাব ছিল না, হাতে পয়সা না থাকলেও দেনা তেমন ছিল না, হয় তো কিছু বকেয়া আদায় ছিল। মেলার সুযোগে আমি মহকুমা হাকিমের বাড়িতে বিদ্যুৎ লাইন স্থায়ীভাবে স্থাপন করি। তবে টেলিফোন সংযোগের কোন সুযোগ ছিল না। কারণ সারা শহরে শুধুমাত্র ডাকঘরেই একটি টেলিফোন ছিল। তবে ব্যর্থতা থেকে গেল একটা। আমার সময়ে যেসব কাজ হলো- বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ, বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীবাস সংস্কার ও সম্প্রসারণ, নানা স্কুল স্থাপনা মেরামত, নাগবাড়ীতে শিশু বিদ্যালয় স্থাপন, অনেক কাঁচা রাস্তা সংস্কার ও পরিবর্ধন, নানা খেলার মাঠের উন্নয়ন, প্রতি থানায় ডাকবাংলোর উন্নয়ন ইত্যাদি- এগুলোর একটি সম্পূর্ণ হিসাব পেশ করতে পারলাম না। আমি আমার পরবর্তী মহকুমা হাকিমের জন্য কাজটি রেখে গেলাম এবং তাকে এই বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে গেলাম। জোয়াদুর রহিম জাহেদ ছিলেন একজন দক্ষ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার স্ত্রীও ছিলেন সপ্রতিভ। তিনি অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে আমার অসম্পূর্ণ হিসাবটি সম্পূর্ণ করে একটি পরিপূর্ণ বিবরণ যথাযথ মহলে (মেলা পরিচালনা কমিটি) পেশ করেন এবং পাস করেও নেন। জাহেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কিছুদিন চাকরিতে ছিলেন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে আমি যখন সচিব তখন আমার সহকর্মী হিসেবে পদায়িত হন। জাহেদ আমার মান রক্ষায় যে পরিশ্রম ও কাজ করেন সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য বাগেরহাটে স্বল্প সময়ের জন্য ১৯৬২ সালে একবার যাই। সম্ভবত বরিশাল, যশোর ও কুষ্টিয়ায় কার্যোপলক্ষে ভ্রমণে গিয়ে একদিনের জন্য পথ পরিবর্তন করে বাগেরহাটে যাই। বাগেরহাটের আরও কয়েকটি ঘটনা এবং কাহিনী আমাকে বলতেই হবে। আমি বাগেরহাটে থাকতে আমার ৪ জন বিশেষ অতিথি বাগেরহাট ভ্রমণ করেন। আমার ভাইবোন ড. শাহ্লা খাতুন এবং আবদুল মুবদি কয়েকদিনের জন্য বাগেরহাটে আসে। তারা তখন ঢাকায় ছাত্র। তাদের নিয়ে আমি সুন্দরবনেও যাই। বাঘের জন্য অপেক্ষা করি; কিন্তু বাঘের দেখা কখনও পাইনি। আমার আর এক অতিথি ছিলেন পেট্রোলিয়াম ব্যবসায়ের একজন বড় সাহেব, আমার সহপাঠী আমানুল্লাহ খান এবং তার স্ত্রী ফরিদা বারি মালিক, যিনি ছিলেন আমার বীথি আপা (তিনিও সহপাঠী)। তারা দু’জনেই ইহলোক ইতিমধ্যে ত্যাগ করেছেন। সম্ভবত তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীথি আপার ভাই পরবর্তীকালে আমেরিকায় বিখ্যাত অধ্যাপক ড. ফজলে বারী মালিকও আসেন। আমার তৃতীয় বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকায় জাপানী কনস্যুলেটের কনসাল জনাব টাকেনাকা। তিনি তার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে একদিনের ভ্রমণে আসেন। তারা খানজাহান আলী মসজিদের কুমির এবং ষাট গম্বুজ দেখে খুবই অভিভূত হন এবং তাদের ছেলে আমার বাড়িতেই এয়ারগান দিয়ে একটি পাখি শিকার করে। টাকেনাকা পরিবারের সঙ্গে আমার একটি সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। আমি ঢাকায় বদলি হবার পর তার শান্তিনগরের বাড়িতে আমাকে প্রায়ই জাপানি খাবার দাওয়াতে যেতে হতো। তার মেয়েটির সঙ্গে একটি বাঙালি ছেলের বন্ধুত্ব হয়। টাকেনাকা এবং তার স্ত্রী আমাকে বললেন যে, তাদের সংস্কৃতিতে বিদেশীর সঙ্গে মাখামাখি তেমন পছন্দসই নয়। টাকেনাকা পরিবার চিরদিন আমাদের বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাকেনাকার উদ্যোগে বাংলাদেশ সমর্থক সমিতি গড়ে উঠে এবং তাতে সংসদীয় নেতা হায়া কাওয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আমার ৪র্থ বিশেষ অতিথি ছিলেন তদানীন্তন রাজশাহী বিভাগের কমিশনার জে. এস. ট্রেনার। তার মতো আলসে আইসিএস অফিসার আমি আর দেখিনি। তার জেলা প্রশাসন সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না বলে আমার মনে হয়। আমি তার আগমনের আগেই সৈয়দ মুরতুজা আলী যখন রাজশাহীর কমিশনার ছিলেন তখন তার বাগেরহাট পরিদর্শনকালে তিনি যে ইন্সপেকশন নোট দেন সেটা আবার ভাল করে দেখে নিই। কারণ আমি আশা করেছিলাম যে, কমিশনার সাহেব এসব বিষয় খতিয়ে দেখবেন। তিনি লঞ্চে করে খুলনা থেকে বাগেরহাট আসলেন। আমি সম্ভবত সকাল ৮টার দিকে তাকে লঞ্চঘাটে অভ্যর্থনা জানালাম এবং সম্ভবত ২ ঘণ্টা পরে তিনি আমার দফতরে আসলেন। বাগেরহাটে আমার সহকারী ছিলেন আরো তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের মূল নামটি শুধু মনে আছে, যথা- জামশেদ, ইসমাইল এবং ওয়াহেদ। তারা সকলেই আমার বয়ঃজ্যেষ্ঠ ছিলেন। কমিশনার সাহেব তাদের একজনের অফিস দেখলেন। বাগেরহাটে তিনজন বিচার বিভাগের মুন্সেফ ছিলেন। তাদের আদালতে তিনি অবশ্যি গেলেন না। তারপরে বললেন যে, তিনি ষাটগম্বুজ ও খানজাহান আলী মসজিদ দেখতে যাবেন। তাকে একটি রিকশায় বসিয়ে পেছনে আরো ২টি রিকশায় অন্য সহকারীদের নিয়ে প্রথমে খানজাহান আলী মসজিদ এবং পরে ষাট গম্বুজ দেখতে গেলাম। প্রথমেই তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, আমার মহকুমায় কোন জীপ গাড়ি নেই। যাবার পথে সাব জেল দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, এর সুপারিনটেনডেন্ট কে? আমি জবাব দিলাম যে, এসডিও হিসাবে আমিই সেই দায়িত্ব পালন করি। তিনি অন্য কোন প্রশ্ন না করে চারদিকে দৃশ্য অবলোকন করে এগিয়ে চললেন। খানজাহান আলীর মাজারে তিনি পুকুরের সিঁড়িগুলোর প্রশংসা করলেন, মেহমানখানায় একটু বসে আবার রিকশায় চড়লেন। তিনি ষাট গম্বুজের চূড়ায় উঠে বললেন তার একটি ছবি উঠাতে। আমি আমার নিজস্ব ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি উঠালাম। তিনি চারদিকে জঙ্গল ইত্যাদি দেখে ফেরত পথে আবার খানজাহান আলীর মাজারে গেলেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি কোন কুমির দেখতে পাননি বলেই দ্বিতীয়বার আবার মাজারে গেলেন। শহরে প্রত্যাবর্তন করার পর আমি তাকে আমার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলাম। তারপর তাকে তার লঞ্চে পৌঁছে দিলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আবার কখন দেখা দেবেন। তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার কাজ করো, আমি তোমাকে যথাসময়ে খবর দিব।’ রাত প্রায় ৮টার সময় তার একটা চিরকুট আমার কাছে পৌঁছুলো। চিরকুটে তিনি সাংকেতিক ভাষায় একটি বার্তা আমাকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন যে, তার অনুবাদ করে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। আসলে সব জেলা প্রশাসক এই সাংকেতিক ভাষা জানতেন এবং শুধু সীমান্তবর্তী মহকুমার প্রশাসকদের কাছে তা দেয়া হতো। তাই আমি ত্রস্তে তার জাহাজে হাজির হলাম এবং তাকে জানালাম যে, আমি এই অনুবাদ করতে পারব না, যেহেতু আমার কাছে সাংকেতিক ভাষার অভিধান নেই। সীমান্তবর্তী মহকুমার প্রশাসক ছাড়া অন্য কোন মহকুমার প্রশাসক এই সাংকেতিক কোডটি পান না। তাকে দেখলাম যে, তিনি মদ্যপান করছেন এবং আমাকেও মদ্যপানে আমন্ত্রণ জানালেন। চলবে...
×