ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের নতুন আমির মকবুল ছিলেন রাজাকার কমান্ডার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৫ নভেম্বর ২০১৬

জামায়াতের নতুন আমির মকবুল ছিলেন রাজাকার কমান্ডার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান। সোমবার সংস্থার ধানম-ি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কাজের অগ্রগতির কথা জানিয়ে আবদুল হান্নান খান বলেন, ফেনীর মকবুল আহমাদ যে রাজাকার ছিল তা স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের কাছে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না। পত্রিকায় কয়েকদিন আগে দুটি অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে প্রতিবেদন বের হলে আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টির তদন্ত শুরু করি। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। কাজ চলছে, অগ্রগতিও আছে। মকবুলের নাম রাজাকারের তালিকায় রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সাত থেকে ১১ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সে বিষয়টি তথ্য-উপাত্তে স্পষ্ট। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে রাজাকার মকবুলের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা করা হবে। জামায়াত আমির যে ‘রাজাকার’ ছিলেন তা কিসের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েছেন জানতে চাইলে হান্নান বলেন, সারাদেশের রাজাকারের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর পর ছয় বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করেন মকবুল আহমাদ। গত অক্টোবরে নতুন আমিরের দায়িত্ব পান তিনি। দায়িত্ব দিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে তাকে রীতিমতো ধোয়া তুলসী পাতা, নিষ্পাপ দাবি করে একের পর এক বিবৃতি পাঠানোর মধ্যেই গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে তার যুদ্ধাপরাধের নানা তথ্য। তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে তার বিচার দাবি করেন। এরপর অভিযোগ তদন্তে প্রথম গত ৮ নবেম্বর তদন্ত সংস্থার সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার জায়লস্কর ইউনিয়নের সিলোনিয়া লালপুর গ্রামের পাল বাড়িতে যায়। সংবাদ সম্মেলনে নুরুল ইসলাম বলেন, তারা পালবাড়ি পরিদর্শন ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। সে অনুযায়ী একটি প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হবে। ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত, কাদের নির্দেশে এ ঘটনা ঘটেছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে। এদিকে ১৯৭১ সালে মকবুল মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা ও রাজাকার কমান্ডার ছিলেন বলে অভিযোগ এনেছেন ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান, দাগনভূঁঞা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালীসহ মুক্তিযোদ্ধারা। তারা ইতোমধ্যে তদন্ত সংস্থার কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মীর আবদুল হান্নান বলেছেন, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মকবুল আহমাদ রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তারই নির্দেশে ফেনীর স্থানীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ফেনী কলেজছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনকে চট্টগ্রামে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। দাগনভূঁঞা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীর বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম সাক্ষী শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালী অভিযোগ করেছেন, মকবুল আহমাদের নির্দেশে দাগনভূঁঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউনিয়নের লালপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়ে ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। মকবুল ছিলেন এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা। বহু হত্যাকা- হয়েছে তার নির্দেশে। এ মুক্তিযোদ্ধা তদন্ত সাপেক্ষে অবিলম্বে এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত জামায়াত নেতা মকবুল আহমাদের বিচার দাবি করেন। শরিয়ত উল্যাহ বাঙ্গালী আরও বলেন, মকবুল আহমাদের নির্দেশে রাজাকার মোশাররফ হোসেন মশা দাগনভূঁঞা উপজেলার খুশিপুর গ্রামের আহসান উল্লাহ নামে অন্য এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। রাজাকার মশা জীবিত আছেন। তার বাড়ি একই উপজেলার সাফুয়া গ্রামে। রাজনৈতিক জীবনে ফেনী-২ আসন থেকে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান মকবুল আহমাদ। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের কাজ চলমান থাকলেও ’৭১-এর ঘাতক, তালিকাভুক্ত রাজাকার কেন্দ্রীয় জামায়াতের আমির মকবুলসহ এ অঞ্চলের দুই শতাধিক রাজাকার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, মকবুল আহমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ওমরাবাদে। ফেনী মডেল হাইস্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসরের পরই জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০৮ সালে মহজোট ক্ষমতায় আসার পরপরই গ্রামের বাড়ি যাওয়া থেকে বিরত থাকেন তিনি। রুকন থেকে পর্যায়ক্রমে দলটির অঞ্চলভিত্তিক পরিচালক, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন। জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতারের পর ৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দলটির ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় তিনি আত্মগোপনে থেকেই দল পরিচালনা করেছেন। ফেনী জেলা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, একাত্তরের মুক্তিকামী মানুষের রক্তের দাগে রঞ্জিত এমন একজনকে শীর্ষ নেতৃত্বে বসিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের কলঙ্ককে অলঙ্কার হিসেবে ধরে রাখতে চাচ্ছে জামায়াত। আবার মিথ্যা বক্তব্য গণমাধ্যমে পাঠিয়ে একাত্তরের অপকর্ম লুকাতে চায় দলটি।
×