ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

তৈরি পোশাক শিল্পে স্বর্ণালি সাফল্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

তৈরি পোশাক শিল্পে  স্বর্ণালি সাফল্য

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তবে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। এটি সময়ের দাবি। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাত্রা শুরু ও অর্জন বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের প্রাথমিক যাত্রা শুরু হয় সত্তর দশকে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের প্রথম চালানটি রপ্তানি হয় ১৯৭৮ সালে। এরপরেই বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায় এবং এই শিল্প দ্রুত বেড়ে ওঠে। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রফতানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১%। ২০১০ সালের মার্চ মাসে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান দাঁড়িয়েছে মোট রপ্তানি আয়ের ৭৬%। সময়ের পরিক্রমায় তৈরি পোশাক আরও সম্প্রসারিত হয়ে ওভেন এবং নিটিং উপখাতে বিভক্ত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দিনকে দিন পোশাক রফতানির পরিক্রমা বেড়েই চলেছে। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে আয় হয়েছে মাত্র ৬২ কোটি ডলার। এতে উৎসাহিত হয়ে একদল নবীন উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে পরবর্তী ৫ বছরে রফতানি আয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আয় ২২৩ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা দেখা দেয়ার পর তৈরি পোশাক রফতানি কমে যাবে এমনটা অনেকে আশঙ্কা করেছিল। চীন, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছিল। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ফলে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়ে বড় বড় সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি কোটা অনুযায়ী তৈরি পোশাক রফতানির জটও খুলেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বমোট পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ১৯,০৮৯.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে তা ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১,৫১৫.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৯,৬৫৩.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এ খাতের অর্জন ৮৮২ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার যা গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়েছে। রফতানি আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সংখ্যাও বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০০০ এর ওপর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রয়েছে। যেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে পোশাক উৎপন্ন করা হচ্ছে। ৯০ দশকে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে এই শিল্প পায় নতুন মাত্রা। বর্তমানে এই শিল্পে মোট শ্রমিকের ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক। বাংলাদেশে অনেক বৃহৎ বহুস্তর বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠার ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্বের তুলনায় আরও সুসংহত হয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক এই তৈরি পোশাক শিল্পের উপর নানা সময়ে এসেছে ছোটবড় অসংখ্য আঘাত। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ নানা সঙ্কট গার্মেন্টস শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। ২০১২ সালের নবেম্বরে তাজরীন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধস কেবল বাংলাদেশকেই নয়, বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় এই খাত। সরকারের ভূমিকা শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানে সরকার অবকাঠামো নির্মাণ, অগ্নি নির্বাপণ, কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন, ন্যূনতম বেতন ভাতা নির্ধারণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থে যেমন আইন প্রণয়ন করেছে, তেমনি রফতানিকে উৎসাহিত করার স্বার্থে রফতানি খাতে কর সুবিধা প্রদানসহ নানাবিধ সুবিধাও দিচ্ছে। এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়াও পোশাক শিল্প খাতকে এগিয়ে নিতে আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। তারমধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যবীমা। স্বাস্থ্যবীমা শ্রমিকদের জীবনে বাড়িয়েছে ভবিষ্যত নিশ্চয়তা, দিয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি। ফলে বেড়েছে শ্রমিক উপস্থিতির হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোগ দেশের নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের জন্যও স্বাস্থ্যবীমা চালুর ক্ষেত্র তৈরি করবে। এতে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিএফআইডি। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদনেও। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে। সম্প্রতি পশমি সোয়েটার্স আয়োজিত ‘অগ্নি নির্বাপণ, উদ্ধার তৎপরতা ও প্রাথমিক চিকিৎসা’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জরুরী সময়ে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম করে তুলতে প্রশিক্ষণটির আয়োজন করা হয়েছিল। এতে মোট ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ কর্মসূচী পরিচালনা করেছে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর ফায়ার সেফটি সেল। এছাড়াও পোশাক কারখানার উন্নয়নে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের পোশাক কারখানার মালিক ও ভবনের মালিকরা ভবন নিরাপদ রাখতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী এ ঋণ পাবেন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ‘আরবান বিল্ডিং সেফটি প্রজেক্টের অধীনে মিলবে এ ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে এ ঋণ পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। কারিগরি সহায়তা উপাদানসহ প্রকল্পের তহবিলের মোট আকার ৪২৪ কোটি জাপানী ইয়েন। আর ঋণ তহবিলের আকার ৪১২ কোটি ৯০ লাখ জাপানী ইয়েন। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ২৯৮ কোটি টাকা। বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচী শ্রম অধিকার নিশ্চিত ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের ২২৫টি তৈরি পোশাক কারখানা আগামী জুনের মধ্যে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচীর আওতাভুক্ত হবে। এই কর্মসূচীর অধীনে বর্তমানে ৯৮টি পোশাক কারখানা আছে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, জর্ডান, হাইতি ও নিকারাগুয়াড় এই সাতটি দেশে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচী পরিচালিত হয়। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা, মান ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং কারখানার ভেতরের কাজের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে এই বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। এইচএ্যান্ডএম, পিভিএইচ, নেক্সট, ইউনিক্লো, পুমা, লি. এ্যান্ড ফাং, নাইকিসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ড এই কর্মসূচীর অংশীদার হিসেবে আছে। লুইস বি ভেনগেস বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ক্রেতাদের দুই জোট এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স এবং সরকারের উদ্যোগে কারখানার বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত পরিদর্শন করছে। এ্যাকর্ডের সদস্য কারখানার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩০টি প্রতিষ্ঠান সব ধরনের সংস্কারকাজ শেষ করে সনদপত্র পেয়েছে। গত মাসেও স্বীকৃতি পেয়েছে তিনটি কারখানা। সন্তোষজনক অগ্রগতি না থাকায় গত মাসের শেষ সফতাহে ছয়টি পোশাক কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট এ্যাকর্ড অন ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশ। ফলে জোটের অধীনে থাকা ব্যর্থ কারখানার সংখ্যা বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এমন কারখানার সংখ্যা গিয়ে ৫৯-এ দাঁড়াল। কর্মপরিবেশের উন্নয়নে ব্যর্থ কারখানার তালিকায় যুক্ত হওয়া ছয় প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের। সত্তর দশকে রোপিত তৈরি পোশাক শিল্প নামক ছোট্ট চারাগাছটি আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির বটবৃক্ষ। দেশের রফতানি আয়ের ৭৬% এই খাত থেকে আসে। বিজিএমইএ এর সভাপতি জনাব সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন ,‘ ইউরোপ,আমেরিকার বাজার জয় করে এখন আমাদের দৃষ্টি রাশিয়ার বাজার।’এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজারো উদ্যোক্তা এবং লাখ লাখ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তার অবস্থান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয়ের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে এই খাতের অগ্রযাত্রা আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করবে।
×