ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ সকালে সাতক্ষীরার রসুলপুরে শেষ জানাজার পর দাফন

শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত এম আর খান

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৭ নভেম্বর ২০১৬

শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত এম আর খান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধায় সিক্ত হলেন বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসায় পথিকৃৎ চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান। রবিবার সকালে রাজধানীর গ্রীন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’দফা জানাজার পর বেলা পৌনে ১২টায় এম আর খানের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে চিকিৎসক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রয়াত এই চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মিরপুরে এম আর খান প্রতিষ্ঠিত শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ও উত্তরার মহিলা মেডিক্যাল কলেজে মরহুমের কফিন নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দুই জায়গাতেও তার জানাজা হয়। রাতে তার মরদেহ যশোরের শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় এম আর খানের নিজ গ্রাম রসুলপুরে অনুষ্ঠিত হবে শেষ জানাজা। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাতক্ষীরার রসুলপুরে এম আর খানকে দাফন করা হবে বলে মরহুমের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানের চিকিৎসা চলে। অধ্যাপক ডাঃ এম আর খান শনিবার বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত কয়েক মাসে দেশে-বিদেশে অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানকে তিনবার অপারেশন করা হয়। এর প্রভাব পড়ে তার শরীরে। পাশাপাশি রয়েছে হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যা। শেষ দিকে তার কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তার স্ত্রী মিসেস আনোয়ারা খান আগেই মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে ডাঃ দৌলতুন্নেসা ম্যান্ডি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। রবিবার বেলা পৌনে বারোটায় জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ এম আর খানের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এই গুণীজনকে সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানান। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেনÑ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এসএম কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান, বিএমএ সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মাহমুদ হাসান, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সলান ও মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এমএ আজিজ, পেশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ কাজী শহীদুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডাঃ রাকিবুল ইসলাম লিটু ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ মিজানুর রহমান। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে এম আর খানকে খুব অসুস্থ অবস্থায় দেখেছিলাম। তারপরও আশা করেছিলাম আরও অনেক দিন বাঁচবেন এই চিকিৎসক। তিনি দেশবাসীকে যা দিয়ে গেছেন তার তুলনা নেই। এম আর খান শুধু একজন মহান চিকিৎসক নন, মহান সমাজসেবক ছিলেন। এই অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক ও দেশের অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান আমাদের সবার প্রিয় মানুষ। তিনি বাংলাদেশের গর্ব এবং এ দেশের চিকিৎসা পেশার আদর্শ। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই পছন্দ করতেন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। রাশেদ খান মেনন বলেন, ডাঃ এম আর খান চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যে আদর্শ রেখে গেছেন সেই আদর্শ নিয়ে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। জাতি হিসেবে আমরা একজন দেশপ্রেমিক গুণী মানুষকে হারালাম। উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন এম আর খান। চিকিৎসা পেশা একটি মানবিক সেবা। এটি তিনি কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান বলেন, অধ্যাপক এম আর খান চিকিৎসা ক্ষেত্রের অভিভাবক ছিলেন। দেশের চিকিৎসা খাতের কিভাবে উন্নয়ন করা যায়, কিভাবে শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায়Ñ সেই পরামর্শ তার কাছে পাওয়া যেত। তার মৃত্যুর ক্ষতি অপূরণীয়। পুরোটা সময় ডাঃ এম আর খানের কফিনের পাশে ছিলেন তার একমাত্র মেয়ে দৌলতুন্নেসা ম্যান্ডি। সকলের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, আমার বাবা যদি কারও সঙ্গে খারাপ কিছু করে থাকেন, মাফ করে দেবেন। বাবা তার কাজের মধ্য দিয়ে তার আদর্শ রেখে গেছেন। মানুষকে ভালবেসেছেন। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। বাবার জন্য সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন দৌলতুন্নেসা ম্যান্ডি। ডাঃ এম আর খান বাংলাদেশের শিশু চিকিৎসার পথিকৃৎ। তার জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার রসুলপুরে। এম আর খান নামে তিনি পরিচিত হলেও তার পুরো নাম মোঃ রফি খান। বাবা আব্দুল বারী খান ও মা জায়েরা খানমের চার ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজো। ১৯৫৩ সালে এমবিবিএস পাস করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিটিএমএ্যান্ডএইচ, এমআরসিপি, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসিএইচ, ঢাকার পিজি থেকে এফসিপিএস, ইংল্যান্ড থেকে এফআরসিপি ডিগ্রী লাভ করেন। এম আর খান পেনশনের টাকা দিয়ে গড়েন ডাঃ এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন। তার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে জাতীয় পর্যায়ের শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতাল, সাতক্ষীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, রসুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তরা উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, নিবেদিতা নার্সিং হোমসহ বহু প্রতিষ্ঠান। এছাড়া তিনি দেশ থেকে পোলিও দূর করতে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন; কাজ করেছেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান ‘আধূনিক’-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে তার ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত সাতটি বই লিখেছেন, যেগুলো দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানতুল্য এই মানুষটির জীবনী স্থান পেয়েছে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হু ইজ হু অব ইন্টেলেকচুয়ালে। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আন্তর্জাতিক ম্যানিলা এ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কার।
×