ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজনন মৌসুমে কঠোর নিষেধাজ্ঞার সুফল মিলবে

আগামীতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলছে রুপালি ইলিশের

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৫ নভেম্বর ২০১৬

আগামীতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলছে রুপালি ইলিশের

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী অংশের রুপালি সম্পদ খ্যাত সুস্বাদু ইলিশ মাছ নিয়ে সর্বশেষ গবেষণায় আশাব্যঞ্জক নতুন তথ্য মিলেছে। প্রায় চার সপ্তাহের সরেজমিন বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আগামীতে ইলিশের আরও অধিক পরিমাণ উৎপাদন ও আহরণের দুয়ার খুলে যাচ্ছে। ইলিশের এবারের প্রজনন মৌসুমে সরকার এই মাছ আহরণের ওপর যে ২২ দিনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করে ব্যাপক সুফল বয়ে এনেছে। মা ইলিশ দলে দলে ডিম ছেড়ে নির্বিঘেœ সাগরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছে। এই সময় আড়ালে-আবডালে যা ধরা হয়েছে তা পরিমাণের তুলনায় যত সামান্য বলে মৎস্য বিভাগ সূত্রে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইলিশ নিয়ে গত ২৬ দিন সরেজমিন গবেষণাটি হয়েছে সাগর ও নদী মোহনায়। ১৪ সদস্যের এই গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর স্টেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান। এই দলে মালয়েশিয়ার দুজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাও ছিলেন। মৎস্য অধিদফতরের জরিপ ও গবেষণা জাহাজ ‘এমভি রূপালী ইলিশ’ যোগে গবেষণা কর্ম শেষ করে গত ৩ নবেম্বর দলটি ফিরে এসেছে। শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে দলের নেতৃত্বদানকারী ড. আনিসুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, গবেষণা শেষে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরির কাজ চলছে। যা শীঘ্রই সরকারের উচ্চপর্যায়ে পেশ করা হবে। তিনি বলেন, ইলিশ রক্ষায় সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে শুরু করেছে। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবার ইলিশের প্রজনন ব্যাপক সফল। জেলেদের বেশি উৎপাত না থাকায় মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে নির্বিঘেœ। এছাড়া সাগর ও নদী মোহনাগুলোতে পানির গুণাগুণও ভাল। ইলিশের খাদ্য সঙ্কটও নেই। এছাড়া ইলিশের পাঁচটি অভয়ারণ্য অক্ষত রয়েছে। ফলে আরও একটি অভয়ারণ্যের জন্য ইতোমধ্যে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক সুপারিশ করা হবে। গবেষণার প্রাথমিক তথ্য নিয়ে ড. আনিসুর রহমান জানান, ‘আমরা ব্যাপকভাবে আশাবাদী। ফলে আগামীতে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণের পরিমাণ আরও অধিক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন সর্বোচ্চ ৮ লাখ টন। এর মধ্য থেকে আহরিত হয় এর অর্ধেক। বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে উৎপাদন ও আহরণ অবশ্যই বেড়ে যাবে। যা মৎস্য খাতে সার্বিকভাবে বড় ধরনের সুফল বয়ে আনবে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বিস্তীর্ণ নদ-নদীতে এবার ইলিশের বিচরণ ঘটেছে। আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহসম্ভাবনা রয়েছে। সাগরের ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্রে গবেষকরা তাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে দুটি পয়েন্টে। বর্তমানে ১২৫টিও বেশি উপজেলার নদ-নদীতে এবার ইলিশ মিলেছে। আগামীতে তা আরও প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড. আনিস জানান, প্রজনন মৌসুমে সরকার এবার যে ২২ দিন ইলিশ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা পর্যাপ্ত। এর চেয়ে বেশি সময় নিষিদ্ধ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলে নিশ্চিত করেন। উল্লেখ্য, গত ১২ অক্টোবর থেকে ২ নবেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণে সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল ব্যাপক তৎপর। চোরাপথে ইলিশ শিকারিদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এতে কেউ কেউ ধরাও পড়েছে। তাদের জেল জরিমানা হয়েছে। এতে জনসচেতনতা আরও বেড়েছে, যা ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে। এদিকে মৎস্য বিভাগীয় সূত্রে জানানো হয়েছে, বর্তমানে চাঁদপুর, শাহবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক ও পদ্মায় রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। নতুন অভয়াশ্রমের প্রস্তাব করা হয়েছে বরিশালে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলিশ গভীর সমুদ্রের মাছ। কিন্তু এ মাছ এক জায়গায় স্থায়ী থাকে না। সাগর থেকে নদীর মোহনা ও নদী মোহনা থেকে সাগরে এর অবাধ চলাচল। এ মাছকে মাইগ্রেটরি বলা হয়। সরকার পক্ষে এ মাছের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও আরও অভয়াশ্রম খুঁজে বের করার জোরালো চিন্তা ভাবনা প্রয়োজন। এতে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ বৃদ্ধি পাবে, তেমনি মৎস্য খাতে চলমান অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। ড. আনিস জানান, মৎস্য খাতে সুস্বাদু ইলিশ এদেশের সম্পদ। লোনা ও মিঠা পানির দুই ক্ষেত্রেই এটির অবাধ বিচরণ। তবে সবচেয়ে বেশি সময় থাকে সাগরের লোনা পানিতে। প্রজনন সময়ে চলে আসে নদী মোহনার মিঠা পানিতে। বিশ্বের এগারোটি দেশে যে ইলিশ পাওয়া যায় তার ৬০ শতাংশই মেলে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী অংশে। গবেষকদের আশা, আগামীতে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশী অংশে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ আরও পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। কারণ, দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর বাংলাদেশের সাগর এলাকা প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য, ডিম থেকে রেণু হয়ে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হতে ১৬ ধাপ পেরোতে হয়। একটি ইলিশের আয়ুষ্কাল ছয় বছরের সামান্য বেশি। তবে তার আগেই অধিকাংশ ইলিশ আহরিত হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, চলমান মৌসুম শেষে প্রায় সাড়ে চার লাখ টন ইলিশ আহরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গবেষকদের পক্ষ থেকে ধারণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এদিকে, গত ২ নবেম্বর রাত বারোটার পর থেকে ইলিশ আহরণের ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর ফিশিং বোট ও ট্রলারগুলো পুনরায় সাগরমুখী হয়েছে। এরই মধ্যে শুক্রবার সাগরে ৩ নম্বর সঙ্কেত সৃষ্টি হওয়ায় মাঝি-মাল্লারা থমকে গেছে। আবহাওয়ার এ সঙ্কেত স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলিশ আহরণ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×