ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

কেন ভুলে যাই এই ভাষা সংগ্রামী বীরের কথা-

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩ নভেম্বর ২০১৬

কেন ভুলে যাই এই ভাষা সংগ্রামী বীরের কথা-

বিডিনিউজ ॥ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত জন্মভূমি না ছেড়ে সেই দেশের গণপরিষদে যিনি প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলে ধরেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, সেই সংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মদিন ছিল বুধবার। বাঙালীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বাঁকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই সংগ্রামী মানুষটির জন্মদিনটি কেটে গেল অনেকটা বিস্মৃতিতেই। এদিন তাঁর স্মরণে কোন কর্মসূচীর আয়োজনের কথা শোনেননি বলে জানালেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি এ্যারোমা দত্ত। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি প্রশ্ন করেন, “আজ কেউ তার কথা বলে না। কেন বলে না? কিসের লজ্জায় বলে না? তার নাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেই কি? এত সংকীর্ণতা কেন? সত্যি কথা বলতে কেন এত লজ্জা?” ১৮৮৬ সালের ২ নবেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তরে রামরাইল গ্রামে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম। ছেলেবেলা থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকলেও রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয় ১৯০৫ সালের পর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি গণপরিষদে উত্থাপনে করে তিনি পূর্ব বাংলায় ‘বীরের মর্যাদা’ পান। কৈশোর থেকে দেশ ও মানুষের প্রয়োজনে ছুটে চলা ধীরেন্দ্রনাথকে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হয় পূর্ব বাংলার নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্যে পাকিস্তানীদের অমানুষিক নির্যাতনে। কুমিল্লা সেনানিবাসে ৮৫ বছরের এই বৃদ্ধের ওপর সেই নির্যাতনের কিছু নমুনা জানা যায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থে সাখাওয়াত আলী খানের এক সাক্ষাতকার থেকে। “ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধ মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বলেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুঁড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশরায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই।’ তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ওই বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বার বার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম।’ বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে- এটা একটা দেখার জিনিস না- নিজের কাজ কর।” “এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তার কপালে এই দুর্ভোগ। তার ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিন ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।” কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের নাপিত রমণী শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারিদের প্রয়োজনে; কারণ তাদের মৃত্যু হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের চুল-দাড়ি কাটার মতো কোন লোক থাকবে না। কথাসাহিত্যিক, গবেষক রশীদ হায়দার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, “দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা এই চরম আত্মত্যাগী সংগ্রামীকে যথাযোগ্য সম্মান দিইনি, তাকে মর্যাদা দিইনি, ইতিহাসে যথোপযুক্ত স্থান দিইনি; পক্ষান্তরে, যে মানুষটির দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্যে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহার করছি, তার নামটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কোথাও, কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।” অনেকেই মনে করেন, বাংলা ভাষার দাবি, বাঙালীর স্বাধিকারের দাবির আন্দোলনে প্রথম ফুলকি জ্বেলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথই। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক তার এক লেখায় সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নয়, বাঙালী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তি হিসেবে গণপরিষদের অধিবেশনের প্রথম দিনই প্রস্তাব করেন, উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করা হোক। “সেদিন পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন দা’র এই প্রস্তাবকে সমর্থন তো করেনইনি, বরং সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন। তীব্র কটাক্ষ এবং বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করেছিলেন প্রভাবশালী মন্ত্রী রাজা গজনফর আলী এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। “পূর্ব বাংলার অন্যান্য মুসলমান সদস্য মুখে তালাচাবি এঁটে দিয়ে অকুতোভয় ধীরেন দার এই হেনস্থা দেখছিলেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যেটা ঘটেছিল সাম্প্রদায়িকতার তীব্র বিষ গায়ে মেখে পাকিস্তানের জন্মের মাত্র ছয় মাস তের দিন পরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পৈশাচিক দৃশ্যপট তখনো এদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।” ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি গণপরিষদে অগ্রাহ্য হয়। সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে গণপরিষদে বাংলা ভাষার অধিকারের প্রস্তাবটি নাকচ হয়। “কিন্তু পূর্ববঙ্গে ছাত্র-যুবক শিক্ষক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ তাকে (ধীরেন্দ্রনাথ) বীরের মর্যাদা দান করেন। ধীরেন দার প্রস্তাব বাতিল করায় এবং গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ানিং কলেজ এবং ঢাকার স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে সেøাগান দিয়ে মিছিল করল রমনা এলাকায়-বর্ধমান হাউসের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি, তখন পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবন) চারপাশে,” এসব কথা লিখে গেছেন গাজীউল হক। বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট হয়। সেই আন্দোলন থেকে গ্রেফতার হন তখনকার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, রফিক, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। এরপর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায়। লেখক কবীর চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করায় বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও ধর্মান্ধ মহল তাকে ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ধারক, পাকিস্তানবিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংসের চক্রান্তকারী’- আখ্যায়িত করেছিল। “ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ওই রকম আরও কিছু মানুষের অবস্থানের মধ্য দিয়েই যে সেদিন বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সূচিত হয়েছিল, আজ তা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। সেই চেতনার বিকাশ ধারাতেই একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করেছে বাংলাদেশ। “কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ সেই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই বর্বর পাক হানাদার বাহিনী যে নির্মম গণহত্যা শুরু করে, তিনি তার শিকার হন। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ।” ধীরেন্দ্রনাথ ও তার ছেলে দিলীপকুমার দত্তকে সেদিন অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার নাতনি এ্যারোমা দত্তের সামনেই। চোখের সামনে দাদু ও কাকাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই ঘটনা এখনও জ্বলজ্বল করছে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এএ্যারোমা দত্তের স্মৃতিতে। এরোমা দত্ত বলেন, “আমাদের বাড়ি কুমিল্লার ধর্ম সাগরের পশ্চিমপাড়ে। ৭১ সালের ২৯ মার্চ রাত দেড়টার দিকে ছয়টা ট্রাক আর একটা জিপে করে ওরা এসেছিল। এসে আমাদের থেকে দাদু আর কাকাকে আলাদা করে। এরপর নিয়ে যায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। “দাদু আর কাকাকে ওরা নির্যাতন করতে করতে নিয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্টেও অনেক নির্যাতনের পর দাদু মারা যান। ময়নামতির কোন এক পাহাড়ের বধ্যভূমিতে তাকে ফেলে দেয়া হয়। এই কথাগুলো জানতে পেরেছি ক্যান্টনমেন্টে নিযুক্ত এক নাপিতের কাছ থেকে। আমার কাকার কী হয়েছে তা আমরা কোনদিনই জানতে পারিনি।” শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরুর পর ১৯১১ সালে কুমিল্লা বারে যোগ দেন ধীরেন্দ্রনাথ। ১৯১৫ সালের বন্যায় ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে আলোচিত হন। পরে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা ‘মুক্তি সংঘ’ গঠন করেন। ১৯৩৬ সালে ধীরেন্দ্রনাথ ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষেও তিনি ত্রাণ তৎপরতা চালান। পরের বছর যোগ দেন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে থাকায় কয়েকবার গ্রেফতার হন ধীরেন্দ্রনাথ। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করলেও তখনকার ত্রিপুরা জেলার বিভক্তির পর জন্মভূমিতেই থেকে যান। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ধীরেন্দ্রনাথকে গৃহবন্দী করা হয়। এর মধ্য দিয়ে তাকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা হয়। তার স্মরণে কুমিল্লা শহরে তার বাসার সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক’, একটি স্টেডিয়াম আছে তার নামে কুমিল্লায়। আর কিছু নেই কোথাও। এ্যারোমা দত্ত বলেন, জনসংখ্যার মধ্যে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিচারে বাংলাই যে পাকিস্তানের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ হওয়া উচিত, সে বিষয়টি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে তুলে ধরার পর গাজীউল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তখনকার ছাত্রনেতারা সমর্থন জানান। সেই পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসে।“আমি জানি, তিনি কোন কিছু আশায় এসব করে যাননি। তবু আমাদের তাঁর কথা বলা উচিত। তার অবদান স্বীকার না করার অবিচারটুকু কেন হতে দেই আমরা?”
×