ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য কমেছে ॥ দুদক চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩ নভেম্বর ২০১৬

দেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য কমেছে ॥ দুদক চেয়ারম্যান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে সার্বিকভাবে দুর্নীতি ও দারিদ্র্য কমেছে বলে উল্লেখ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। একই সঙ্গে শুধু প্রভাবশালী নয়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন ও দুর্নীতিবাজদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে দুদক কাজ করছে বলে জানিয়েছেন। তিনি পুলিশের কর্মকা- সর্বক্ষণিক নজরদারির জন্য স্বাধীন কমিশন গঠনের আহ্বান জানান। বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ‘রাষ্ট্রপতির কাছে ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ’ উপলক্ষে দুদকের পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। চলতি বছরের ১৪ মার্চ দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমবারের মতো সংবাদ সম্মেলন করলেন তিনি। চেয়ারম্যান বলেন, দেশে যে দুর্নীতি আগের চেয়ে অনেক কমেছে তার প্রমাণ হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। দুর্নীতি কমার কারণে দেশের মানুষের দারিদ্র্যতাও কমেছে। এর ফলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগও দুর্নীতি কমার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি দেশের দুর্নীতি কমাতে মিডিয়ার অনস্বীকার্য অবদানের কথা স্বীকার করে মিডিয়াকে ধন্যবাদ দেন। যে কোন দেশে দুর্নীতি কমলেই দারিদ্র্য কমে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের দুর্নীতিবাজ অথচ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দুদকের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তবে বলতে পারি যে, সকল দুর্নীতিবাজদের অবশ্য আমরা গ্রেফতার করতে পারব না, কিন্তু তাদের দুর্নীতি বন্ধে অন্তত ছুঁয়ে দিতে পারব। ছোঁয়া মানে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, তদন্ত বা মামলা করতে পারব। শুধু প্রভাবশালী নয়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। দুদকের মামলায় সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির সাজা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, আদালতের রায়ের বিষয়ে আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তবে আমরা প্রতিটি মামলাতেই চাই, আসামির সাজা হোক। আমরা দুর্নীতি কমাতে এ পর্যন্ত দেশের ২৯টি স্থানে গণশুনানির আয়োজন করেছি। এর মাধ্যমে নাগরিক সেবা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছি। ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের চলমান সিস্টেমের পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সিস্টেম পাল্টাতে ৩২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশ সরকার আমলে নেবেন কি-না তা সরকারের বিষয়, কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধে এসব সুপারিশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনতে কোন বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ কোন প্রভাব খাটাতে আমার এখানে আসেন না। এ সময় তিনি নিজের মোবাইল ফোন দেখিয়ে বলেন, এই ফোনে আগের মতো কলও আসে না। আমাকে কেউ প্রভাবিত করতে পারবে না। এছাড়া দুদক কর্তৃপক্ষ কাউকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দেয় না। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাগণই (আইও) তাদের আসামিদের গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দেশে দুর্নীতি কমানোর জন্য দুদকের পক্ষ থেকে যে ৩২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে এর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলোÑ দেশের মোট অপরাধ মামলার ৮০ শতাংশ যেহেতু ভূমিসংক্রান্ত, তাই ভূমিসংক্রান্ত সব প্রতিষ্ঠান এক ছাদের নিচে আনা, গ্যাসসহ অন্যান্য বিল তিন মাসে একবার নেয়া, সরকারের সব ধরনের ক্রয়-বিক্রয় ই-টেন্ডারের মাধ্যমে করা, রাস্তা নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করা, যাতে রাস্তা ভেঙ্গে গেলে তারা মেরামত করতে বাধ্য থাকেন। ফলে ঠিকাদারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। এছাড়া যে প্রকৌশলী রাস্তার এস্টিমেট করবেন সেই প্রকৌশলী দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা যাবে না। এর বাইরে কাজের বিল একসঙ্গে দিতে হবে। প্রতিটি অফিসে গণশুনানির আয়োজন করা, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা, শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের সুপারিশ করেন। টেকনিক্যাল পদের জন্য আলাদা নিয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যোগ্য ও মেধাবীদের চাকরিতে পদায়নের ব্যবস্থা করা। কারণ যোগ্য, সৎ ও মেধাবী লোকজনের কারণে দেশে দুর্নীতি কমে আসে। দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছ, ২০১৫ সালে দুদকে মোট অভিযোগ এসেছে ১০ হাজার ৪১৫টি। যার মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়েছে এক হাজার ২৪০টি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে ১৬৫টি, মামলা হয়েছে ৫২৭টি, পুরনো মামলাসহ ২০১৫ সালে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে ৬১৪টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৮৮টি মামলা, সাজা দেয়া হয়েছে ৬৯টি মামলায়, খালাস দেয়া হয়েছে ১১৯টি মামলায়। ফলে সাজা দেয়ার হার ৩৭ শতাংশ। সংবাদ সম্মেলনে ২০১৫ সালে সাজা হওয়া মামলার পরিসংখ্যান দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দুদকে অনেক অভিযোগ আসে। কিন্তু সব অভিযোগ দুদকে তফসিলভুক্ত হয় না। ফলে সব অভিযোগ অনুসন্ধানের পর সাজার পরিমাণ হয় কম। এ সমস্যা দূর করতে সাজার হার বাড়াতে আমরা পুরাতন আইনজীবী পরিবর্তন করে নতুন আইনজীবী নির্বাচন করেছি, যাতে সাজা পাওয়া মামলার হার আরও বাড়ানো যায়। ২০১৫ সালে সাজার হার যেখানে ৩৭ শতাংশ ছিল, ২০১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এ হার বেড়ে ৫১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে এতেও আমি সন্তুষ্ট নই। আমাদের কাছে দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি দমন একটি অংশ মাত্র। নিজেদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমাদের মধ্যেও দুর্নীতি রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো কমানোর। সারাদেশে দুর্নীতি কমেছে। দুর্নীতি কমলে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দুদক। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির ঘটনায় করা ৫৬ মামলার তদন্ত সাড়ে ১৩ মাসেও শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এটি একটি জটিল মামলা। আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। তবে এটাও সত্যি, আমাদের লোকজনের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তবে আরও নতুন বেশ কয়েকটি মামলাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি বলেন, অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে কমিশনে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে অভিযোগ এসেছে- এমন ইঙ্গিত দেন দুদক চেয়ারম্যান। ইকবাল মাহমুদ বলেন, পুলিশের নামে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে পুলিশ ছাড়াও আমাদের চলা অসম্ভব বটে। তাই আমরা সরকারকে সুপারিশ করেছি, পুলিশের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং একটি স্বাধীন জুডিশিয়াল পুলিশ কমিশন গঠন করতে। প্রতিটি পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির কর নথি থাকা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি উপার্জনক্ষম ব্যক্তির কর দেয়া উচিত। যদি কর ফাইল থাকে তাহলে সম্পদের হিসাব সহজে নেয়া সম্ভব হয়। দুর্নীতি মামলার কোন আসামি যেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য দেশের সব বন্দরে আসামির পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে দুর্নীতিবাজরা পালাতে না পারে। সংবাদ সম্মেলনে দুদক কমিশনার এএসএম আমিনুল ইসলাম (তদন্ত) ও ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ (অনুসন্ধান), দুদক সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল, প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা উপ-পরিচালক প্রণব ভট্টাচার্য প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
×