ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পালতোলা নৌকা এখন শুধুই স্মৃতি

নাইয়ারে... নায়ে বাদাম তুইলা, কোন্ দূরে যাও চইলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২ নভেম্বর ২০১৬

নাইয়ারে... নায়ে বাদাম তুইলা, কোন্ দূরে যাও চইলা

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ পাল তোলা নৌকা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য। চিরচেনা খাল-বিল, নদী-নালার এই দেশে গত চার যুগ ধরে এখন আর পাল তোলা নৌকা দেখা যায় না। বুড়োরা তো বটেই, গাঁয়ের বধূ থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়েরাও এখন আর নানা রঙের বাহারি পাল তোলা নৌকা দেখতে নদীর পাড়ে ছুটে যায় না। নববধূরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার জন্য আজকাল পাল তোলা নৌকার বায়না ধরে না। নদীতে সারি সারি পাল তোলা নৌকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন কেবলই স্মৃতি। পাল তোলা নৌকা নিয়ে রয়েছে কতই না মধুর সুরের গান। নাইয়া রে... নায়ে বাদাম (পাল) তুইলা কোন্ দূরে যাও চইলা/মাঝি নাও ছাইড়া দে, মাঝি পাল উড়াইয়া দে/ দে দে পাল তুলে দে, মাঝি হেলা করিস না, ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনায়/জীবনের নৌকা চলে হেলেদুলে পাল তুলে - এ ধরনের নানা ভাটিয়ালি গানের মাঝেও পাল তোলা নৌকার নানান স্মৃতি দোলা দেয়। এসব গান শুনলেই মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই পাল তোলা নৌকার দিনগুলোর স্মৃতিতে। অথচ সেই পাল তোলা নৌকা গ্রাম-বাংলা থেকে এখন হারিয়ে গেছে। এক সময় বড় বড় নৌকায় পাট, ধান, গমসহ নানা ধরনের পণ্য বহন করা হতো। আধুনিক যুগে নৌকার পরিবর্তে এসেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা আর বড় বড় মহাজনী নৌকার পরিবর্তে এসেছে ট্রলার। বাংলার নদী-নালা খালে-বিলে হরেক রকমের নৌকা চলতে দেখা যেত। নাইওরি নৌকা, কেড়ায়া নৌকা, সাপুড়িয়া নৌকা, ভোট নৌকা, পানসি নৌকা, বৌচোরা, গয়না, লক্ষ্মী বিলাস, গ-ী বিলাস, বজরা, খেয়া নৌকা, কোষা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা, বাইচের নৌকা ও মহাজনী নৌকাসহ আরও কত নাম। সেসব দিন আজ অতীত, শুধুই স্মৃতি। কোষা নৌকা, খেয়া নৌকা ও ডিঙ্গি নৌকা ছাড়া আরও কোন নৌকাই এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। গ্রাম-গঞ্জে কোথাও কোথাও এখনও প্রতিযোগিতামূলক নৌকাবাইচ হয়। এ নৌকাবাইচ দেখতে নদীর দু’পাড়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ এখন ভিড় করে। পাল তোলা নৌকার ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। পাল তোলা নৌকা আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাহারি রঙের পাল তোলা নৌকা এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না। ইঞ্জিন নৌকার দাপটে পাল তোলা নৌকার দিন ফুরিয়ে গেছে প্রায়। অথচ একটা সময় ছিল যখন নৌকায় পাল তুলে দিয়ে শক্ত হাতে হাল ধরে মাঝি মনের আনন্দে গাইত ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে... আমি আর বাইতে পারলাম না’-এ ধরনের নানান গান। এক সময় নদীতে পালতোলা নৌকা দেখে ছেলে-বুড়ো সবাই মুগ্ধ হতেন। মনে হতো নদীজুড়ে যেন রঙের মেলা বসেছে। পালের সারা গায়ে থাকত রঙ-বেরঙের কাপড়ের টুকরার জোড়া। ছোট ছোট কাপড় জোড়া লাগিয়ে তৈরি হতো বিশাল আকৃতির মনকাড়া পাল। আবার লাল, বেগুনি, কমলা, সাদাসহ বাহারি রঙের বিশাল আকৃতির পাল তোলা হতো। প্রায় ২০-৪০ ফুট লম্বা মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে পাল তুলে দিত আকাশের দিকে। আর পাল নিজের গায়ে বাতাস আটকে নৌকা ঠেলে নিয়ে যেত দূর-দূরান্তে। তখন শুধু একজন দক্ষ মাঝি পেছনে বড় আকৃতির কাঠের বৈঠার হাল ধরে বসে থাকত। বাতাস না থাকলে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে দলে দলে গুণ দিয়েও নৌকা টেনে নিয়ে যাওয়া হতো। বৈঠা তো ছিলই। সবই আজ অতীত স্মৃতি। বাংলাদেশে বর্ষাকালে নৌকা প্রচুর ব্যবহার হয়। নৌকার চালককে বলা হয় মাঝি। নৌকার বিভিন্ন অংশ হলো- খোল, পাটা, ছই বা ছাউনি, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস্তুল, নোঙর, গলুই, বৈঠা, লগি ও গুণ। নৌকা প্রধানত কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। মাছ ধরার ডিঙ্গি আকারে ছোট, আবার পণ্য পরিবহনের নৌকা আকারে বেশ বড় ছিল। ছই বা ছাউনি তৈরিতে বাঁশ ব্যবহার করা হয়। খোলকে জলনিরোধ করার জন্য আলকাতরা ব্যবহার করা হয়। লগি তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। পাল তৈরি হতো শক্ত কাপড় জোড়া দিয়ে। আবার জোড়া ছাড়াও বড় কাপড় দিয়েও পাল তৈরি করা হতো। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াস (৬২) বলেন, ১৯৭০ সালেও শীতলক্ষ্যা নদীতে বিভিন্ন আকৃতির ও বিভিন্ন রঙের পাল তোলা নৌকা চলতে দেখা গেছে। কখনও কখনও নদীতে বাতাস না থাকলে গুণ টেনে নৌকা নিয়ে যেত। কিন্তু ১৯৭৩ সালের পর থেকে আর পাল তোলা নৌকা শীতলক্ষ্যা নদীতে দেখা যায় না। এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে পাল তোলা নৌকা। বর্তমানে নৌকায় ইঞ্জিন লাগিয়ে দ্রুত গতিতে চলাচল করছে। ইঞ্জিন নৌকার দাপটে পাল তোলা নৌকা আজ বিলীয়মান। চাঁদপুর জেলার মতলব (উত্তর) থানার তালতলি গ্রামের আদি বাসিন্দা ও বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রঘুনাথপুরের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম (৫৯) জানান, পদ্মা নদী পাড় হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা হতে পাট বোঝাই পাল তোলা নৌকা নারায়ণগঞ্জে নদী বন্দরে নোঙর করত। স্বাধীনতার আগে মেঘনা নদীতে পাল তোলা নৌকা সারি সারিভাবে চলতে দেখা যেত। তখন পাল তোলা নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। এসব নৌকায় বড় মাস্তুল থাকত। মাস্তুলের সঙ্গে রশি দিয়ে পাল বাঁধা হতো। মাস্তুলের উপরে চাকার মতো গোলাকৃতি একটি বস্তু থাকত। ফলে মাঝিরা রশি টেনে পাল মাস্তুলের উপরে তুলে দিত। তিনি আরও বলেন, পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদী দিয়ে পাল তোলা সারি সারি বড় আকৃতির নৌকা পাট বোঝাই করে বিভিন্ন গঞ্জে যেত। এ পাল তোলা নৌকাতেই মাঝিদের খাবারের ব্যবস্থা থাকত। কোন কোন সময় কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত মাঝিদের নৌকাতেই থাকতে হতো। চল্লিশোর্ধ নারী-পুরুষের কাছে আজকের শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভিড়ে অতীতের সেই পাল তোলা নৌকা এখন শুধুই স্মৃতি...।
×