ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রগতিশীলরা মফস্বলে জামায়াতী শিক্ষকরা ঢাকায়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ নভেম্বর ২০১৬

প্রগতিশীলরা মফস্বলে জামায়াতী শিক্ষকরা ঢাকায়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বড় ধরনের পদোন্নতি হলেও পদায়নে অনিয়ম ও বিশেষ একটি গ্রুপের একচ্ছত্র দাপটকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষা প্রশাসনে। শিক্ষা ক্যাডারে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ প্রগতিশীল অনেক শিক্ষক বছরের পর বছর মফস্বলে চাকরি করলেও কথিত নিরপেক্ষ ও বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা ঢাকাতেই আছেন বহাল তবিয়তে। পদোন্নতি হলেও ঘুরে ফিরে তারা বছরের পর বছর ঢাকায় লোভনীয় পদগুলোতেই আছেন। বদলি না হওয়ায় শিক্ষা বোর্ড থেকে অধিদফতরের প্রতিটি স্তরের গড়ে উঠেছে অবৈধ সিন্ডিকেট। এদিকে এ সঙ্কট সমাধানে বোর্ডগুলোর মধ্যে কর্মকর্তাদের বদলির সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। শিক্ষা বোর্ডগুলোতে কিছু কর্মকর্তা বছরের পর বছর ধরে চাকরি করায় অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে অভিযোগ তুলে পদক্ষেপের দাবি তুলেছে শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মচারীরা। ঢাকাসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কর্মচারী নেতারা বোর্ডগুলোর সিন্ডিকেট ভাংতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। তবে বদলি পদায়ন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাবেক এপিএসের প্রভাব নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আফছারুল আমীন বলেন, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডাররা মূলত কলেজ শিক্ষক। তাঁদের প্রশাসনে কাজ করার চেয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানেই বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। সরকারী কলেজগুলোতে শিক্ষক সঙ্কটও রয়েছে। এর পরও যারা ডেপুটেশনে প্রশাসন ও শিক্ষা বোর্ডগুলোতে রয়েছেন, তাদের সরকারী নিয়মানুযায়ী তিন বছর পর বদলি করা উচিত। কারণ ক্লাসরুমে না গেলে তো প্রশাসনে নীতিনির্ধারণ করা যায় না। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও বোর্ডের কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক এসএম ওয়াহিদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আন্তঃশিক্ষা বোর্ড বদলির সুপারিশ করেছিল। সুপারিশ ছিল যে, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যেককে প্রয়োজনে এক বোর্ড থেকে অন্য বোর্ডে বদলি করা হয়। তবে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ নিয়ে কাজ আগায়নি এখনও। এদিকে সম্প্রতি পদোন্নতি হলেও পদায় নিয়ে মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার ভুলে ভরা পদায়ন ও প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মহাপরিচালক বলেন, আসলে ভুল হলেতো সমাধান হবেই। তা হয়ও। ঢাকায় একটি কলেজে পদায়নে জটিলতা দেখা গেছে। সেটাও সমাধান করা হবে। পদোন্নতি পাওয়া একজন অধ্যাপকের স্থলে আরেকজনকে সেখানে দেয়া হয়েছে। বহু প্রগতিশীল শিক্ষক অধ্যাপক হলেও একটি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে চিহ্নিত সরকার বিরোধী একজনকে পদায়ন দেয়া নিয়েও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে মহাপরিচালক কোন কথা বলতে রাজি হননি। তবে শিক্ষা ক্যাডারের প্রগতিশীল শিক্ষকরা এসব কাজের জন্য দায়ী করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় পদোন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যে পদোন্নতি পেয়ে ৯৩২ জন শিক্ষক সহযোগী থেকে অধ্যাপক ও সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। শীঘ্রই আরও প্রায় ৪০০ শিক্ষককে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। পদায়নের জায়গা না থাকায় ২০৫ জন অধ্যাপককে স্বপদে রাখার শর্তে পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু সেই শর্ত ভঙ্গ করে এখন চলছে মন্ত্রণালয় ও বিসিএস শিক্ষা সমিতির বিশেষ একটি গ্রুপের পছন্দমতো প্রার্থীদের পদায়ন।শিক্ষা প্রশাসনের সিনিয়রদের অনেক পদই জুনিয়ররা দখল করে রেখেছেন এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই শিক্ষকরা বছরের পর বছর প্রশাসনে চাকরি করছেন। তাদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন পদক্ষেপই নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা প্রশাসনে এখনও অদৃশ্য হাতে চলছে বদলি বাণিজ্য। ফলে টাকা দিলেই ভাল পদায়ন পাওয়া যায়। এরা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নাম ভাঙ্গিয়ে বদলি নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাই দুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী তদ্বির বন্ধে আদেশ জারি করেছেন। যদিও এতে মন্ত্রণালয়ে সাধারণ শিক্ষকরা যেতে না পারলেও প্রভাবশালী গ্রুপটির কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত দুই অক্টোবর ৩৮৫ জন সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর গত ২০ অক্টোবর আরও ২০৫ জনকে সহযোগী থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর গত ২৯ অক্টোবর বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সভায় সহকারী অধ্যাপক থেকে ৩৪২ জন শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এখন প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কার্যক্রম চলছে। শীঘ্রই প্রায় ৪০০ জন শিক্ষককে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। সূত্র জানায়, অধ্যাপকদের পর্যাপ্ত পদায়নের জায়গা না থাকলেও পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু এই পদোন্নতির শর্ত ছিল, স্বপদেই থাকতে হবে তাদের। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের নিজেদের শর্ত ভেঙ্গে পদায়ন করতে শুরু করেছে। ফলে অনেক শিক্ষক যারা সহযোগী থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে স্বপদেই রয়েছেন, আবার সেখানেই সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়াদেরও পদায়ন করা হচ্ছে। ফলে এক পদে দুজনের নামই রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে সাধারণত প্রেষণে আসেন সরকারী কলেজের শিক্ষকরা। অথচ অনেকেই আছেন যারা প্রশাসনে চাকরি করতে এসে তাদের মূল পেশা শিক্ষকতাই ভুলে গেছেন। অনেক শিক্ষকই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে প্রশাসনে চাকরি করছেন। আবার তদ্বিরের জোরেই অনেক জুনিয়র কর্মকর্তা সিনিয়র পদও দখল করে রেখেছেন। অথচ সরকারী চাকরি বিধিমালায়ও তিন বছর পর পর কর্মকর্তাদের বদলি করার বিধান রয়েছে। জানা যায়, একই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে শিকড় গেড়ে বসা কর্মকর্তারা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ সংসদীয় কমিটির অনেক সদস্যেরও। একই অভিযোগ তুলেছেন কর্মচারীরাও। এমনকি শিক্ষা বোর্ডগুলোতে প্রচুর আয়ের উৎস থাকায় সেখান থেকে কর্মকর্তারা কোনভাবেই বদলি হতে চান না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি দুর্নীতি রোধে বোর্ড কর্মকর্তাদের এক স্থানে না রেখে আন্তঃবোর্ড বদলির সুপারিশ করেন। কিন্তু সেই সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন করেনি মন্ত্রণালয়। বাস্তবায়নে বাধা সেই চক্রই। কর্মচারী সমিতির অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবির চৌধুরী ২০০৯ সালে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন পান। এরপর সহযোগী অধ্যাপক থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে অধ্যাপক পদমর্যাদার সচিব পদে তাকে পদায়ন করা হয়। এরপর থেকে তিনি ওই পদে রয়েছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) মাসুদা বেগমও রয়েছেন ২০০৯ সাল থেকে। নানা অভিযোগ থাকার পরও তিনি সাত বছর ধরে একই পদে রয়েছেন। তিনি সরকারী কর্মকর্তা হয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি পদও দখল করে রেখেছেন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক পদে রয়েছেন আবুল বাশার। তিনি ২০০৯ সালে আসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরে। এরপর ছিলেন ঢাকা বোডের্র উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে। সে সময় প্রশ্ন ফাঁসেরও অভিযোগ উঠে। তারপরও তাকে আবার মাদ্রাসা বোর্ডে পদায়ন করা হয়েছে। ২০১০ সালে মাউশি অধিদফতরে উপ-পরিচালক পদে পদায়ন পান ড. আশফাকুস সালেহীন। তিনি এখন ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক। ২০০৩ সাল থেকে ঢাকা বোর্ডে উপ-পরিচালক পদে কর্মরত রয়েছেন আবুল ফজল এলাহী। ২০০২ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরে পদায়ন পান মোঃ মুজিবর রহমান। ২০১৪ সালে বদলি হন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম)। এরপর আবার ২০১৫ সাল থেকে রয়েছেন মাদ্রাসা বোর্ডের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে মাউশি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে আছেন মঈনুল হোসেন। তিনি এখন আছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে। নানা অনিয়ম ও কোটি টাকা সরকারী অর্থ অপচয়ের জন্য অভিযুক্ত হলেও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর আছেন এক যুগেরও বেশি। কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন কম্পিউটার শাখাকে বছরের পর বছর ধরে অনিয়মের আখড়া তৈরি করা হয়েছে। জানা যায়, মাউশি অধিদফতরের মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম কামাল উদ্দিন হায়দার ২০০৯ সালে ঢাকা বোর্ডে উপ-সচিব হিসেবে পদায়ন পান। এরপর ২০১৩ সালে মাউশি অধিদফতরে সহকারী পরিচালক ও বর্তমানে উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শামসুল আলম প্রমাণিকের একান্ত সচিব ছিলেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সচিব মোঃ ইমরুল হাসানও ২০১০ সালে মাউশি অধিদফতরে পদায়ন পান। এরপর ২০১৩ সাল থেকে এনসিটিবিতে রয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকে নায়েমে কর্মরত রয়েছেন উপ-পরিচালক রিয়াদ চৌধুরী। মাউশি অধিদফতরের উপ-পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন সরকার, ওসমান ভূইয়া কর্মরত রয়েছেন প্রায় সাত বছর ধরে। আইন কর্মকর্তা আবুল কাশেম ২০০৪ সাল থেকে ও সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) মোঃ সাইফুল ইসলাম রয়েছেন ২০০৫ সাল থেকে। মাউশি অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেনও কয়েক বছর ধরে রয়েছেন। এ কর্মকর্তাকে নিয়ে অসন্তোষ প্রগতিশীলদের মাঝে। তার বিষয়ে প্রগতিশীল শিক্ষকরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেই। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলছেন, তিন বছর হলেই একজন কর্মকর্তাকে বদলি করা দরকার। বছরের পর বছর ধরে একই ব্যক্তি এক প্রতিষ্ঠানে থেকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব ও বিসিএস শিক্ষা সমিতির মহাসচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী বলেছেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ ছিল যারা বোর্ডের স্থায়ী কর্মকর্তা তাদের জন্য। আমরা যারা ডেপুটেশনে আছি তাদের সরকার চাইলে যে কোন সময় বদলি করতে পারে। এজন্য সুপারিশের দরকার নেই।
×