ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন মিরাজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

বিশ্ব রেকর্ড গড়লেন মিরাজ

মোঃ মামুন রশীদ ॥ এমন রঙ্গিন অভিষেক আর কোন বাংলাদেশী বোলারের হয়নি। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সিরিজেই অনেকগুলো ইতিহাস গড়লেন ডানহাতি অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের ম্যাচে তিনি দুই ইনিংসে ছয়টি করে ১২ উইকেট নিয়েছেন। এটি কোন বাংলাদেশী বোলারের এক টেস্টের সেরা বোলিং নৈপুণ্য। সবমিলিয়ে সিরিজে ১৯ উইকেট। এর আগে দুই ম্যাচের সিরিজে আর কোন বাংলাদেশী বোলার এমন নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। ১২৯ বছর আগে অভিষেকের দুই টেস্ট সিরিজে ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পেসার জেমস ফেরিস। সেদিক থেকেও নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়ে দেশসেরা বোলার হয়েছেন। আর অফস্পিনার হিসেবে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টের তিন ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে। তবে যেকোন বোলারের নৈপুণ্য বিবেচনায় ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে এমন নৈপুণ্য দেখানোর ঘটনা টেস্ট ইতিহাসে আরও ৫ জনের আছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক থেকে শুরু করে দুই ম্যাচে দারুণ বোলিং করে সিরিজসেরা হয়েছেন। এরপরও ১৯ বছরে সবেমাত্র পা দেয়া এ ডানহাতি অফস্পিনার জানালেন ধারাবাহিকতা রেখে দীর্ঘদিন দলে টিকে থাকতে চান। আর সে কারণে অনেক পরিশ্রম করার প্রত্যয় জানালেন এ তরুণ। ঘূর্ণি বলে উপমহাদেশে আসা যেকোন সফরকারী দলই বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে যায়। স্পিন যেন এক গোলক ধাঁধা। সেই ধাঁধায় এবার ইংল্যান্ডকে আটকে ফেলার পরিকল্পনা আগেই ছিল বাংলাদেশের। আর সে কারণেই প্রথম টেস্টেই দলে সুযোগ পান ডানহাতি অফস্পিন অলরাউন্ডার মেহেদি। সেখানেই ক্যারিশমা দেখান বল হাতে। চট্টগ্রাম টেস্টে বল হাতে ৮০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে দেন ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। সেটি ছিল সর্বকনিষ্ঠ বাংলাদেশী হিসেবে অভিষেকে ৫ উইকেটের বেশি শিকারের প্রথম নজির। সার্বিকভাবে সেটা অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশী কোন বোলারের দ্বিতীয় সেরা নৈপুণ্য। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৮ রানে মাত্র ১ উইকেট শিকার করেন। শুরুতে অচেনা আগন্তুক হয়ে দলে ঢুকে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দিয়েছিলেন। স্পিনবান্ধব উইকেট ও পরিবেশও সুবিধা করে দিয়েছিল মিরাজকে। এমনটাই অনেক ভেবেছেন তার দ্বিতীয় ইনিংসের বোলিং দেখে। কিন্তু মিরপুরে চট্টগ্রামের মতো ভয়াবহ স্পিনিং উইকেট ছিল না। এখানেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে গেলেন মিরাজ। নিজের জাত চেনালেন প্রথম ইনিংসে ৮২ রানে ৬ উইকেট শিকার করে। বুঝিয়ে দিলেন চট্টগ্রামের নৈপুণ্যটা ক্ষণিক সময়ের ‘ম্যাজিক’ বা ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের স্পিন ‘জুজু’ কারণ ছিল না। এরপরই তিনি ইংল্যান্ড শিবিরের জন্য বিভীষিকার নাম হয়ে গেলেন। ঘূর্ণির ইন্দ্রজালে এ সিরিজে এশিয়ার মাটিতে ইতিহাসের সেরা বিদেশী ব্যাটসম্যান এ্যালিস্টার কুককেও তিনবার শিকার করেছেন। মিরাজের ঘূর্ণি ছোবলে দ্বিতীয় ইনিংসে দুঃসহ বিপর্যয়ে নীল হয়ে গেছে ইংল্যান্ড। ২৭৩ রানের জয়ের লক্ষ্যটা ছোঁয়া একেবারেই সহজ হয়ে যাবে মনে হচ্ছিল যখন কুক-ডাকেট উদ্বোধনী জুটিতে ১০০ রান যোগ করেন। ডাকেটকে বোল্ড করে সেই জুটিতে চিড় ধরিয়ে ইংল্যান্ড শিবিরে প্রথম হানা দেন মিরাজ। এরপর তার সঙ্গে যোগ দেন বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান। মূলত এই সিরিজের আগে এই সাকিবের স্পিনের ওপরই প্রতিটি সিরিজে অন্যতম আস্থা ও ভরসা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন মিরাজ। এবার দারুণ এক জুটি হলো দু’জনের। আবার ৬ উইকেট নিলেন মিরাজ, এবার ৭৭ রান দিয়ে। আর সাকিব নিলেন ৪ উইকেট। ডানহাতি আর বাঁহাতি- দুই স্পিনার মিলে ঘূর্ণি ফাঁদে ফেলে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং টপঅর্ডার, মেরুদ-, টেলএ্যান্ড সবই ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিলেন। জাত চিনিয়ে দিলেন মিরাজ। দুই টেস্টের সিরিজে ১৯ উইকেট যা ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচের সিরিজে কেউ পায়নি আগে। ১৮৮৭ সালে অসি পেসার ফেরিস দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে অভিষেক হওয়ার পর নিয়েছিলেন ১৮ উইকেট। ১২৯ বছরের সে ইতিহাস পাল্টে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে দেশেরও সেরা নৈপুণ্যের রেকর্ড গড়েছেন। দুই ম্যাচের সিরিজে ২০০৫ সালে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ঘরের মাটিতে এনামুল হক জুনিয়র নিয়েছিলেন ১৮ উইকেট। ওই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ২০০ রানে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। সেটাই ছিল সিরিজসেরা ও ম্যাচসেরা বোলিং নৈপুণ্য কোন বাংলাদেশীর। সিরিজে ১৮ উইকেট ও দ্বিতীয় ম্যাচে ১৫৯ রানে ১২ উইকেট শিকার করে দেশের সেরা হয়ে গেলেন ১৯ বছর বয়সী মিরাজ। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচে তিন ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের ঘটনা টেস্ট ইতিহাসে এটি ষষ্ঠ। তবে সে তালিকায় নেই কোন অফস্পিনার। ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার টম রিচার্ডসন, ১৯০১ সালে আরেক ইংলিশ পেসার সিডনি বার্নস, ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেগব্রেক গুগলি বোলার গ্রিমেট, ১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান পেসার রডনি হগ ও ১৯৮৮ সালে ভারতের লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানি এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। অফস্পিনার হিসেবে তাই বিরল এই কীর্তি প্রথম গড়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন মিরাজ। তবে অনেকেই হারিয়ে যান। শুরুটা দুর্দান্ত হওয়ার পরেও। কিন্তু মিরাজ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চান। তিনি বলেন,‘এই উইকেটে যেভাবে বল করেছি, উইকেট একটু সাহায্য করেছে। এখানে পাঁচটা ছয়টা করে উইকেট পেয়েছি বাইরের দেশে এভাবে নাও পেতে পারি। আমাকে আরও মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। আরও অনেক ভাল করে অনুশীলন করতে হবে। আমরা যেন দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি যেকোন কন্ডিশনে।’ ধারাবাহিকভাবেই নৈপুণ্যটা দেখাতে চান মিরাজ। তিনি বলেন,‘আমার লক্ষ্য ধারাবাহিকভাবে পারফর্মেন্স করা, এটাই কিন্তু এ্যাভারেজ পারফর্মেন্স বোঝায়। আমি চেষ্টা করি দলকে কিছু দেয়ার জন্য। সবসময় দলকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করি। আমি যদি উইকেট পাই সেটা যেন দলের কাজে লাগে।’
×