ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বচক্ষে দেখে গেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট

ফতোয়াবাজদের মুখে কুলুপ, নারী জাগরণে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২১ অক্টোবর ২০১৬

ফতোয়াবাজদের মুখে কুলুপ, নারী জাগরণে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ ‘বিয়ের আগে ও পরে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ’ -কয়েক বছর পূর্বেও বাংলাদেশের কতিপয় ফতোয়াবাজ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ ফতোয়া জারি করায় শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া স্বাধীন এ দেশের প্রান্তিক জনজীবনে দারিদ্র্য লেগেইছিল। গৃহকর্তার সামান্য উপার্জনে কোনমতে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায় চলছিল গ্রামীণ জীবন। ফলে অভাবের সংসারে মহামারি আকারে বাল্যবিয়ে ও ইভটিজিংয়ের (যৌন হয়রানি) ঘটনাছিল দেশব্যাপী। চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর হারের পাশাপাশি কর্মহীন বেকার থাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছিল অসংখ্য যুবক। নারীদের নিয়ে দেয়া ফতোয়াবাজদের মুখে কুলুপ সেঁটে দিয়ে সর্বত্র নারী জাগরণের মাধ্যমে আজ শিক্ষিত সমাজ গঠনসহ ক্ষুধামুক্ত জীবন, অভাবমুক্ত সংসার, বাল্যবিয়ে ও যৌনহয়রানি প্রতিরোধ, ঘরে ঘরে চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মক্ষম করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতি। তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাল্যবিয়ে বন্ধ, যৌনহয়রানি প্রতিরোধ, চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে গেছে। হাতের মুঠোয় এখন সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এসবের মূলে রয়েছেন সমাজের নারী জাগরণের অগ্রদূত বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই অনুপ্রেরণায় গ্রামের নারী কৃষিভিত্তিক নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবারিক আয়ে ভূমিকা রেখে সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করছেন। পাশাপাশি দারিদ্র্য কমায় স্বাবলম্বীরা নারী আজ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এসডিএফ) এসব নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থার ‘নতুন জীবন’ লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (এনজেএলআইপি) নামের একটি প্রকল্প বরিশালসহ দেশের কয়েকটি জেলায় এখনও চলমান। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে গ্রামের দরিদ্র নারীর অবস্থার পরিবর্তন ও দারিদ্র্যবিমোচনে তাদের অগ্রণী ভূমিকা স্বচক্ষে পরিদর্শন করতে গত ১৮ অক্টোবর বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া ও উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠী গ্রামে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। তিনি সুফলভোগীদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন ও জাগ্রত নারীদের সঙ্গে কথা বলে ভীষণ খুশি হয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি কলেরা ও যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশের অনুকরণীয় সাফল্য এবং মানুষের কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করেন। নতুন জীবন নামক প্রকল্প পরিদর্শন করে জিম ইয়ং কিম বলেন, আমরা জানি বাংলাদেশের মানুষ খুবই পরিশ্রমী। তারা ভাল কাজ করতে জানেন, সহজে পিছিয়ে পড়েন না। তাদের এই অবস্থা দেখে আমরা উৎসাহিত। তাই আমরা বাংলাদেশে আরও অর্থায়ন করব। তিনি আরও বলেন, দরিদ্র নারীদের অবস্থার পরিবর্তন দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। অতীতে এই দরিদ্র নারীর কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। বর্তমান সরকারের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এখানে অর্থায়ন করেছি। ফলে নারী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দলীয়ভাবে মাছ চাষ, গাভীর খামার, সবজি চাষ, কম্পোস্ট সার প্রস্তুত-বিক্রির মাধ্যমে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। দরিদ্র নারীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় শেষে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি সুবিধাভোগী নারীদের সঙ্গে আলাপ করে আনন্দিত হয়েছি। এই নারীরা আত্মপ্রত্যয়ী। আমি তাদের আরও উন্নয়ন দেখতে চাই। তিনি আরও বলেন, এখানকার দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা আগে স্কুলে যেত না। শিক্ষাগ্রহণে বাংলাদেশ সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে বর্তমানে তারা স্কুলে যাচ্ছে। ফলে তারা অতীতের চেয়ে এখন ভালর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রাকুদিয়া থেকে উজিরপুর উপজেলার ভরসাকাঠি গ্রামে নবনির্মিত ভরসাকাঠি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার (ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র) পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেন, আমি নিজে একজন চিকিৎসক। বাংলাদেশ কলেরা ও যক্ষ্মা রোগ প্রতিরোধে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে; যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুকরণ করে সুফল পেয়েছে। এ দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে গ্রামীণ নারীর অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। এসব নারী দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নারীদের নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের দেয়া সার্টিফিকেটের পর এখন দেশের বিভিন্ন সংস্থা দরিদ্র নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধপপাশা ইউনিয়নের পূর্বপাংশা গ্রামের দরিদ্র-অসচ্ছল নারীকে অর্থনৈতিক আলোতে ফিরিয়ে আনতে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক কর্তৃক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর ওই গ্রামের শতাধিক নারীর মাঝে বিনামূল্যে গবাদিপশু, হাঁস ও কবুতর বিতরণন করা হয়েছে। প্রতিসপ্তাহে গবাদিপশুর খাবারের জন্য ২১০ টাকা করে ব্র্যাক থেকে দেয়া হবে। ব্র্যাকের অতিদারিদ্র্য কর্মসূচীর মাঠ কার্যক্রম পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন তরান্বিত করার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের ন্যায় এ ধরনের কর্মসূচী নিয়ে অন্যান্য সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে আরও সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে। অপরদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীর সুস্বাস্থ্যের জন্য ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচীর মাধ্যমে গত ১৯ অক্টোবর সকালে জেলার গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নের ১৮নং দক্ষিণ চাঁদশী ও ২৪নং উত্তর নাঠৈ পল্লী সমাজের মাধ্যমে মেডিক্যাল ক্যাম্পেন অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পেনে দু’শতাধিক নারীর বিনামূল্যে রক্তচাপ, ওজন নির্ণয় ও চোখ পরীক্ষাসহ গ্লুকোমিটারের মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরীক্ষা, চশমা এবং ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচীর উপজেলা ম্যানেজার মোঃ আব্দুল কুদ্দুস ও সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচীর উপজেলা প্রতিনিধি সঞ্জিৎ হালদার বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ১২নং হরহর পল্লী সমাজের মাধ্যমে শতাধিক নারীকে অনুরূপ চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে উভয় এলাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতায় উদ্বুদ্ধকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডে তাদের এ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।
×