ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিতে বিশ্ব সঙ্গীতাঙ্গনে উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিতে বিশ্ব সঙ্গীতাঙ্গনে উচ্ছ্বাস

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ মার্কিন সাহিত্য ইতিহাসে নতুন কাব্যিক উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান। ৭৫ বছর বয়সী এ শিল্পীর এ অর্জনে উচ্ছ্বসিত গোটা বিশ্ব। উচ্ছ্বাসের জোয়ারে শামিল হয়েছেন ভারতের রুপালি জগতের তারকারাও। ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিকে সঙ্গীতের জন্য ‘গর্বের মুহূর্ত’ বলেছেন তারা। এ আর রাহমান থেকে আমজাদ আলী খান, ঋষি কাপুর থেকে প্রসেনজিৎ-ডিলানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন তারা। গান দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য এ আর রাহমান নিজের ফেসবুকে ডিলানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, বব ডিলানের নোবেল বিজয় উদযাপন করছি। গানের মাধ্যমে তিন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। তিনি মানুষকে নিজের গান দিয়ে ভিন্ন এক জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডিলানের নোবেল জেতায় দারুণ খুশি আমজাদ খান, তিনি মানুষকে অনেক প্রশান্তি দিয়েছেন, দারুণ গানও উপহার দিয়েছেন। প্রত্যেক দেশের গায়ক একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। কারণ আমরা একই কাজ করি, এটাই সঙ্গীতের সৌন্দর্য। ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তির খবরে গীতিকার জাভেদ আখতারও আনন্দিত, আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। ব্যাপারটা দারুণ এ কারণে যে, মানুষ এখন নির্দিষ্ট একটা ঘরানাকে বেছে নিচ্ছে না। আমরা গানকে সাহিত্য হিসেবে মানতে চাই না সহজে। গজল এবং নাসাম কিন্তু এক ধরনের সাহিত্যই। বব দারুণ একজন মানুষ। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন। ঊষা উত্থুপের উচ্ছ্বাসটা যেন কমছেই না, এটা দারুণ একটা ব্যাপার। যারা গানকে সাহিত্যের অংশ হিসেবে ভেবেছেন তাদের ধন্যবাদ। দারুণ একটা সিদ্ধান্ত এটা। আমি উচ্ছ্বসিত। আদনান সামি তার টুইটে লিখেছেন, যখন আপনার সঙ্গীত এবং হৃদয় মিশে যাবে তখনই সেটা পৃথিবীতে প্রভাব ফেলবে। অভিনেতা ঋষি কাপুর লিখেছেন, যখন আমরা তরুণ ছিলাম তখন আমি আর আমার বোন ববকে নিয়ে লড়াই করতাম। আমি তার গানের কথা কখনই বুঝিনি, সে এটা দারুণ পছন্দ করত। আজ আমার বোন পৃথিবীতে নেই, আশা করি সে এ খবরে খুশি। সুরকার ভিশাল দাদলানিও খুশি ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিতে, আমি আমার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ডিলানের সাহিত্যে নোবেল পাওয়া দারুণ একটা ব্যাপার। তার সঙ্গীত আমার কাছে স্বাধীনতার অন্য নাম। কুনাল কোহলি বলেছেন, ডিলানের অনেক আগেই নোবেল পাওয়া উচিত ছিল। টালিগঞ্জের অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, এ খবরটি জানতে পেরে খুবই আনন্দিত। তবে বব ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তিতে সমালোচনার ঝড়ও কিন্তু কম নয়। মশকরা করে বলা হচ্ছে, দারিও ফো যেন পরপার থেকে এ কৌতুকটা ছুড়ে মারলেন পৃথিবীতে। সারাবিশ্বের মিডিয়ায় যেদিন নোবেল বিজয়ী ইতালিয়ান সাহিত্যিক দারিও ফোর মৃত্যুর খবর বের হলো সেদিনই বব ডিলান নোবেল পেলেন সাহিত্যে। দারিও ফো-ই একমাত্র নোবেলজয়ী সাহিত্যিক, যার লেখালেখিতে কোন আগ্রহ ছিল না। নেই উল্লেখযোগ্য কোনো বই। বব ডিলানে যেন ফিরে এলেন দারিও ফো। বলা হচ্ছে, লিখিত ভাষাকে সুরক্ষার যে মহান ব্রত ও ঐতিহ্য সুইডিশ একাডেমির ছিল, বব ডিলানকে নোবেল দিয়ে তার বারোটা বাজানো হলো! ডিলান উঁচুমানের শিল্পী, কিন্তু তার লিরিক কি নোবেল পাওয়ার উপযুক্ত? কিংবা একটা আত্মজীবনীই কি যথেষ্ট? খোলা চোখে তা-ই মনে হবে। সাহিত্যে নোবেল বলতে বোঝায় গল্প-কবিতা-উপন্যাস; ডিলান এসবে নেই। একাডেমির ট্র্যাডিশনাল ছকের অনেক বাইরে ডিলানের অবস্থান। ডিলান আরেক ঘরানার কথক; মৌখিক, গণমুখী। সঙ্গীতকে সাহিত্য বিবেচনায় এনে প্রথম নোবেল দেয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ফ্রেম ভাঙ্গার সাহস তখন দেখিয়েছিল নোবেল কমিটি। সেটা ছিল শুরুর দিকের বিপ্লব। এরপর আবার ওই ছকে আটকে যায় কমিটি। বব ডিলানকে দিয়ে আবার প্রথা ভাঙল সুইডিশ একাডেমি। ডিলানের গান যদি পাঠ করা হয় তবে হয়ত বলা যাবে- এটা নোবেলের সঙ্গে যায় না, ওই মানটা পায়নি। কিন্তু গান তো পাঠের জন্য নয়, গাওয়ার জন্য। পুরস্কারটি এবার দেয়া হয়েছে এক গীতিকবিকে, কবিতা-লেখককে নয়। শব্দ ও সঙ্গীতকে উপলব্ধি করতে হবে সামগ্রিকতার মানদণ্ডে। সুইডিশ একাডেমি ১৭ শতকের গীতিকবি কার্ল বেলমানকে সম্মান জানাতে গিয়ে সে সময়েই বলেছিল, কবিতায় তো গায়ন থাকতে হবে। কবিতাকে বেজে উঠতে হবে, রিনরিন করে ধ্বনিত হতে হবে, শূন্য ভরিয়ে দিতে হবে কবিতার সুরে। তিনি শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের কবি- কর্ণকবি : একাডেমির সেই প্রত্যাশা এ বছর ডিলানে এসে আকৃতি পেল। সামগ্রিকতার স্কেলে কবিতা ও গান তো একই শরীরের দুই পরিপূরক অস্তিত্ব। কবিতার অক্ষর আর শব্দ যদি মাংস হয়, কণ্ঠের সুর তো আত্মা। সাহিত্যের লিখিত ফর্মের বাইরে ভোকাল ফর্মের দিকে তাই চোখ তুলে তাকাল এবার একাডেমি। বিস্তৃত হলো সাহিত্যের পরিধি। আড়াই হাজার বছর আগে হোমার কিংবা স্যাফো যখন কবিতা লিখেছিলেন কিংবা কালীদাস, লিখেছিলেন তারা শোনানোর জন্যই। মুখে মুখে ফিরত কবিতা। কবিতা লেখা হতো আবৃত্তির জন্য, মঞ্চে গাওয়ার জন্য, নৃত্যের গায়ে তাল জুড়ে দেয়ার জন্য এবং কবিতা গাওয়া হতো বাজনা বাজিয়ে। অর্থাৎ কথন বা গায়কী সাহিত্যের ইতিহাস লেখ্য সাহিত্যের ইতিহাসের চেয়ে পুরনো ও সমৃদ্ধ। বব ডিলান গায়কী সাহিত্যেরই প্রতিভূ। আমরা এখনও হোমার পড়ি, স্যাফো পড়ি এবং আনন্দ পাই, অনুপ্রাণিত হই। একই ভাবে বব ডিলানকেও পড়তে হবে, বার বার পড়তে হবে। বব ডিলান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পয়িার জন্য শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন।
×