ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবিউল হুসাইন

ছোট্ট রাসেলের ছোট্ট জীবন

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

ছোট্ট রাসেলের ছোট্ট জীবন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শেখ রাসেল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ হৃদয়-ব্যথিত নৃশংস ঘটনার অন্যতম উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তার জন্ম হয়েছিল ৩২ নম্বর ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৭ দিনের স্বল্পায়ু জীবন ছিল তার। আজ বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৫২ বছর। কিন্তু নির্মম রাজনীতির ষড়যন্ত্রে শেখ রাসেল তার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভাবিসহ কী নিষ্ঠুর, অমানবিক ও পৈশাচিক হত্যাকা-ে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিল তা ভাবলে আমাদের মন, বোধ ও অনুভব গভীর বেদনায় ভরে ওঠে। পৃথিবীর জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের ইতিহাসে এ রকম উদাহরণ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। তার ৫২তম জন্মদিনে বেদনাভরা মন নিয়ে আমরা তাকে শ্রদ্ধা, আদর ও ভালবাসায় একান্তভাবে স্মরণ করি। একটি দেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু কী চরমভাবে তার নিজের জীবন, পরিবারবর্গের ১৮টি জীবন এবং সঙ্গে নিষ্পাপ, নিরপরাধ ও নিষ্কলঙ্ক ১০ বছরের কিশোর-শিশু শেখ রাসেলের জীবন দিয়ে চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছেন তা পৃথিবীর চলমান ঘটনায় বিরল ও অসম্ভব এক নিষ্ঠুর রক্তাক্ত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। কী প্রাণবন্ত ও হাসিখুশি ছিল রাসেল। সবার আদরের মধ্যমণি। বঙ্গবন্ধু দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের খুব অনুরাগী ছিলেন। রাসেলের বড় বোন আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার আমাদের ছোট রাসেল সোনা শীর্ষক লেখা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বঙ্গমাতাকে দার্শনিক রাসেলের লেখা থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে শোনাতেন। তাই তাঁর ছোট ছেলের জন্ম হলে রাসেলের নামে শেখ রাসেলের নাম রাখেন। রাসেলের জন্মের পর পরই তিনি গ্রেফতার হন এবং সদ্যজাত সন্তান রেখে জেলে যান। তার বয়স যখন দেড় বছর তখন ১৯৬৬ সালের ৬ দফা প্রস্তাব দেয়ার জন্য পাকিস্তানীরা আবার শেখ মুজিবকে কারাবন্দী করে। তখন ছোট্ট রাসেল তার বাবাকে আকুল হয়ে খুঁজতে থাকে কাঁদতে কাঁদতে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে। এই ৩২ নম্বরের বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। তোমরা অবশ্যই সেই জাদুঘর দেখে আসবে তাহলে শেখ রাসেলকে আরও ভালভাবে জানতে ও বুঝতে পারবে। মনে মনে ভাববে এই পথ, এই ঘর, এই মাঠ, এই বারান্দায় সে ঘুরত। রাসেলকে নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আছে। তোমরা জানলে আনন্দ পাবে। ছোট্ট রাসেলের ছোটবেলায় বেজায় সাহস আর সব কিছু জানার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। তাদের বাসায় আম্বিয়ার মা নামে এক বুয়াকে সে খুব ভালবাসত আর মানত। তার কোলে চড়েই রাসেল ঘুরত, খেত আর বিভিন্ন আবদার করত। হাসু আপা মাঝে-মধ্যে তার কান্নাকাটি টেপ রেকর্ডে ধরে রাখতেন। একবার কান্নার আওয়াজ টেপে বাজিয়ে দিলে তাদের মা বঙ্গমাতা দৌড়ে রান্না ফেলে রাসেলের কি হলো ও কাঁদছে কেন বলে কাছে এসে দেখেন কী কা- টেপে কান্নার শব্দ রাসেলের। সবাই হেসে ওঠেন খুব মজা পেয়ে। রাসেল পিপড়ে দেখে একদম ভয় পেত না। দেখলেই ধরে ফেলত আর দেখত পিল পিল করে কোথায় আর কেমন করে কেন যায়। তোমাদের তখন সেই বিখ্যাত ছড়াটার কথা মনে পড়ে যায়। নিশ্চয় পিপীলিকা, পিপীলিকা কোথা যাও একা একা দাঁড়াও না একবার ভাই। তাই না। একবার হলো কি, রাসেল একটা মোটা কালো পিপড়েকে ধরে ফেলল। আর অমনি কুটুস করে পিপড়েটা তার ছোট্ট হাতের আঙ্গুলে কামড় বসিয়ে দিল আর যায় কোথায়। শুরু হলো রাসেলের কান্না, আঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। পরে ওষুধ দিলে সব ঠিক হয়। ওইসব পিপড়েকে সে ভুট্টো নামে ডাকত। আর একবার হয়েছে বেশ কা-! টমি নামে রাসেলদের এক পোষা কুকুর ছিল। রাসেল তাকে নিয়ে চলত, ফিরত আর খেলত। খেলতে খেলতে একদিন হঠাৎ টমি ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। তখন সে শেখ রেহানার কাছে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে। রেহানা বলেন, কি হয়েছে রাসেল, তুমি কাঁদছ কেন। কাঁদতে কাঁদতে রাসেল বলে, টমি আমাকে বকা দিয়েছে। রেহানা হাসতে হাসতে রাসেলকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে আদর দেন আর সবাই হেসে ওঠেন। রাসেল তাদের কবুতরগুলোকে খুব পছন্দ করত। মায়ের সঙ্গে গিয়ে উঁচুতে বাঁধা কবুতরের খোপে কবুতরের জন্য শস্যদানা উঠিয়ে দিত। রাসেল তার বাবার জন্য খুব কান্নাকাটি করত। জেলখানায় সবার সঙ্গে গিয়ে বাবাকে দেখে যেমন ভীষণ খুশি হতো আবার ফিরে আসার সময় কাঁদতে কাঁদতে আসত। আব্বাকে না পেয়ে রাসেল তাই তার মাকে আব্বা বলে ডেকে উঠত আর চোখের জলে ভাসত। সে চোখের জলকে ময় বলত। শেখ হাসিনা যেমন বলেছেন চোখে পানি মুখে হাসি রাসেল তেমনই ছিল। রাসেলের একটা তিন চাকার সাইকেল ছিল। যেটা চালিয়ে সে সারা বাড়ি ঘোরাঘুরি করত। তার একটা ছোট ‘মপেট’ মোটরসাইকেল ছিল। একবার দুর্ঘটনায় সেই মপেটের পাইপে পা আটকিয়ে গরমে পুড়ে গিয়ে রাসেল খুব আহত হয়। পরে বেশ ভুগে ওষুধ পত্তর দিয়ে ঠিক হয়। এমনই চঞ্চল আমুদে আর অনুভূতিপ্রবণ ছিল সে। রাসেলের মাছ ধরার শখ ছিল। কিন্তু ধরে আবার ছেড়ে দিত। এই ছোট্ট মানুষটির কী ব্যথিত জীবন। রাসেলের বড় দুই বোন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা ১৯৭৫ সালে জার্মানিতে বড় ভগ্নিপতি অনুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার কাছে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দুই ভাই শেখ কামাল এবং শেখ জামালের সদ্য বিয়ে হয়ে গেছে। তখন তাদের সঙ্গে তারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাসেলের আশ্চর্য বেদনার ভাগ্যলিপি। সে সময় রাসেলের জন্ডিস হয় তাই তার আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। সে যদি তখন যেতে পারত বাংলাদেশের ইতিহাস আজ এক ৫২ বছর বয়সী সাহসী বাঙালী আর নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে পেয়ে অবশ্যই মহিমান্বিত ও উজ্জ্বল হতে পারত। তোমরা ভাবতে পার কী নির্মম ঘটনা আর সেই দৃশ্য। শিশু রাসেলকে এক পাষ- ঘাতক যখন সে দেখে যে নিচে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমাকে মেরো না, আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো। তখন তাকে সে হাত ধরে চলো তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি চলার পথের উপরে নিয়ে যায়। তার চারদিকে বাবা, ভাই-ভাবিদের রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ এক রক্তের নদীতে ভাসছে। হাহাকার ভরা দুঃসময়ের সেই অসহায় হতভাগী শিশু রাসেলকে তারা মায়ের নিথর নিঃসার দেহের কাছে নিয়ে মাথার খুব কাছে থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেদনার্ত এক জঘন্যতম ধাতব যান্ত্রিক শব্দ করে আমাদের, তোমাদের এবং বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালীর হৃদয় মন ও স্বপ্নকে গভীর শোকে সন্তাপে আর দুঃখে ভরিয়ে বিষণœœ ও অবসন্ন করে তুলেছিল যার রেশ এখনও বহমান। তবে এটাও ঠিক পরবর্তী কর্তব্যকে একত্রিত ও বেগবান হতে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সাহায্য করেছিল।
×