ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারিগর কেমন আছে ॥ সপ্তসুর আর পঞ্চবোলের

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

কারিগর কেমন আছে ॥ সপ্তসুর আর  পঞ্চবোলের

বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামের সা রে গা মা পা ধ্বনি এই সপ্তসুর আর তবলার তে রে কে টে তাক এই পঞ্চবোল বা তাল ছাড়া পৃথিবীতে কোন সুর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। আবিষ্কার আর প্রযুক্তির যুগে নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র এসেছে। ইলেকট্রিক গিটার, ডিজিটাল মিউজিক্যাল কী বোর্ড, আধুনিক ড্রাম সেটসহ কত কি...। পিয়ানো একার্ডিয়ান পিয়ানো সবই পরিবর্তিত ডিজিটাল হয়েছে। শুধু কয়েকটি বাদ্যের পরিবর্তন হয়নি। যেমন ঢোল, খোল, তবলা, বেহালা, হারমোনিয়াম, হারমোনিকা বা মাউথ অরগ্যান। সুরের যন্ত্র প্রযুক্তিতে যতই আধুনিকায়ন হোক সপ্তসুর ও পঞ্চবোল ছাড়া কোন কিছুই সুরে বাজানো যায় না। প্রযুক্তিতে আধুনিকায়িত অনেক বাদ্যযন্ত্র বিদেশে তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে এই দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে সুরের প্রাথমিক পাঠ হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, খোল, গিটার, বেহালা, স্কুল ড্রাম ইত্যাদি। বগুড়ায় গত এক শ’ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে হারমোনিয়াম তৈরি করছে সুধীর এ্যান্ড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠাতা ঠাকুর যোগেশ চন্দ্র সূত্রধর এক শ’ বছরের বেশি সময় আগে বগুড়ায় আসেন। বগুড়ায় প্রথমে বসতি গড়েন গোকুলের এক গ্রামে। ঠাকুর যোগেশ চন্দ্র গত হওয়ার পর তার ছেলে সুধীর চন্দ্র সূত্রধর বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম বানানোর দীক্ষা নেন। তিনি হারমোনিয়াম বানিয়ে ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। জার্মান ও ভারত থেকে রিড এনে হারমোনিয়ামে সংযোজন করায় সুনাম কুড়াতে থাকেন। একসময় হারমোনিয়ামের নাম দেন সুধীর এ্যান্ড কোম্পানি। সুধীর চন্দ্র গত হওয়ার পর তার ছেলে নিখিল চন্দ্র সূত্রধর হারমোনিয়াম তৈরির এই প্রতিষ্ঠান ধরে রেখেছেন। বর্তমানে নিখিল চন্দ্র সূত্রধর তার বড় ভাই অধীর চন্দ্র সূত্রধরকে সঙ্গে নিয়ে হারমোনিয়াম তৈরি ও বাজারজাত করছেন। ১৯৮১ সালে গোকুল থেকে তারা আসেন বগুড়া শহরের কালিতলায়। বছর কয়েক আগে শহরের চেলোপাড়ায় স্বল্প পরিসরের এক ঘরে কোন রকমে হারমোনিয়াম তৈরি করছেন। বললেন বর্তমানে হারমোনিয়াম তৈরির যে উপকরণ মিলছে তা দিয়েই বানাচ্ছেন। বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়ামের বাঁশির সংখ্যা ৩৭টি করে দুই স্তরে ৭৪টি ও ৪২টি করে দুই স্তরে ৮৪টি। ক্রেতারা যে পরিমাণের বাঁশির হারমোনিয়াম চায়, তাই বানিয়ে দেয়া হয়। তারা নিজেরাই টিউনিং করেন। দুই ধরণের হারমোনিয়াম (হাওয়াইয়ান ও বক্স) তারা বানান। হারমোনিয়ামের অবকাঠামো কাঠ সাধারণত সেগুন ও বার্মাটিকের হয়। হালে প্লাস্টিকেরও বডি তৈরি হচ্ছে। হারমোনিয়ামের যে অংশ দিয়ে ভেতরে হাওয়া ঢোকানো হয়, তার নাম বেলু। এই বেলু তৈরিতে কাঠের সঙ্গে চৌকোনাভাবে এঁটে দেয়া হয় পিজবোর্ড। যাকে আমরা রিড বলি, প্রস্তুতকারকদের কাছে তার নাম পর্দা। এর নিচেই থাকে স্প্রিং। রিড বা পর্দা হয় দুই স্তরে সাজানো ৩৭ ও ৪২ ঘাটের। রিড নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশিকে। প্রতিটি বাঁশি পিতলের পাতলা আবরণে রিডের প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে। বাঁশি ও রিডবোর্ড বসানো হয় সেগুন কাঠে। হারমোনিয়ামের বেলু টেনে রিড চেপে এই বাঁশির সুর নিয়ন্ত্রিত হয়। রিডের সঙ্গে সুর নিয়ন্ত্রক ছোট্ট রিড থাকে, যা কালো রঙের। প্লাস্টিকের সিট কেটে রিড বানানো হয়। নতুন উন্নত হারমোনিয়ামের দাম ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। মাঝারি মানের হারমোনিয়াম ১৮শ’ থেকে ৬ হাজার টাকা। একটা সময় হারমোনিয়ামের বাঁশি ও রিড এসেছে জার্মানি ও ভারত থেকে। হারমোনিয়াম তৈরির পর সুর টিউনিং করতে হয়। হারমোনিয়ামের সুরের সৌন্দর্য নির্ভর করে টিউনিংয়ের ওপর। অনেক সময় শিল্পী নিজেই টিউনিং করে। এই যে এত নিখুঁত করে হারমোনিয়াম বানান কারিগর, কিন্তু তিনি সুরে গান তৈরি করতে পারেন না। শুধু সুরের টিউনিং ঠিক হলো কি না তাই দেখেন। বাকিটা শিল্পীর সাধনা। নিখিল চন্দ্রের লেখাপড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। হারমোনিয়ামের সঙ্গে তবলা-ডুগি ছাড়া সুরের বৈচিত্র্য আসে না। কথায় আছে চুন ছাড়া পান আর তবলা ছাড়া গান একই। এই তবলা তৈরি হয় বগুড়ায়। চেলোপাড়ায় গোপাল চন্দ্র সরকার বংশপরম্পরায় তবলা-ডুগি তৈরি করছেন। তার ঠাকুরদা সোনাকুড়ি ও বাবা রঙ্গলাল দাস বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে গোহাইল রোডে প্রথম তবলা ডুগির দোকার দেন। বর্তমানে গোপাল চন্দ্র দাস তবলা-ডুগি বানিয়ে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তার পূর্ব পুরুষ ছিলেন মানিকগঞ্জে। তবলার অবকাঠামো তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় শিশু, আম আর নিম কাঠ। তে রে কে টে তাক শব্দ শৈলীর জন্য ব্যবহার হয় ছাগলের চামড়া। চামড়ার মধ্যের ছোট গোলাকৃতির কালো অংশটি বানাতে কামারের দোকানের লোহাচূর্ণ সংগ্রহ করতে হয়। তার সঙ্গে ভাতের আঠা এঁটে বসানো হয়। তবলার চার ধারের যে ফিতা তা মোষের চামড়ার। এই ফিতার সঙ্গে কাঠের টুকরো বসিয়ে বোল ঠিক করা হয়। তবলার সঙ্গী ডুগির অবকাঠামো মাটির ও পিতলের হয়ে থাকে। তবলা ও ডুগির চামড়া সংগ্রহ করা হয় নাটোর সদরের চকআমহাটি এলাকা থেকে। কাঠ সংগ্রহ করা হয় নওগাঁর মান্দা থেকে। তবলা-ডুগি সেট বিক্রি হয় ১২শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকায়। হারমোনিয়ামসহ সব বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলতে তবলা সঙ্গত করতেই হয়। মূলত তবলা-ডুগির বোলই সকল সুরের তাল এবং সৌন্দর্য। স্ত্রী ও পাঁচ মেয়ে নিয়ে গোপাল চন্দ্রের সংসার। তবলা-ডুগির নির্মাতারা তাল বা বোল ঠিক হলো কি না তাই শুধু বোঝেন। তবলা বাদক ঠিক করে নেয় তাল। সুরের মূর্ছনায় যতই ডিজিটাল আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আসুক যতই বলা হোক তবলায় তে রে কে টে তাক হয়ে গেছে আজ বরবাদ। তার পরও মেলোডিয়াস সুর সৃষ্টিতে তবলা, ডুগি ও হারমোনিয়াম চিরন্তন হয়ে থাকবে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×