ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

লালনের অচিন জগত

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

লালনের অচিন জগত

বদেল মাননানের মতে সঙ্গীত মহাজাগতিক ভাষা; অখ- মহাকালের আত্ম-অন্বেষা। লালন এই ধারারই সবচেয়ে বড় সাধক; পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাউল লোক কবি। বাউল সম্রাট লালনের গানে একাধারে আধ্যাত্মিকতা, সুফীবাদ , হিন্দু দর্শন, বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শনের অপূর্ব মিশেলে সৃষ্টি হয়েছে লালনের রূপময় জগত। বহুমুখী প্রতিভার লালন একাধারে সুরকার, গীতিকার ও সুরস্রষ্টা। তার গানে এক ঐন্দ্রজালিক মোহ ছড়িয়ে থাকে যা আমাদের মনের সবচেয়ে নিগূঢ় প্রদেশে নাড়া দেয়। আমাদের দর্শন ও সাহিত্যে মরমীবাদ বলে যে ধারাটি প্রচলিত ইংরেজীতে সে ধারাটি মিষ্টিসিজম হিসেবে পরিচিত। আধ্যাত্মিক সাধনা বিষয়ক এ ধারার সাধকেরা সাধনার এক স্তরে গিয়ে অন্তরের গভীর প্রদেশে সত্য শিহরণে উপলব্ধি করে। সাধকের এ উপলব্ধি জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, মেধায় বা প্রজ্ঞায় হয় না, হয় সংজ্ঞায় বা বোধিতে। মিষ্টিক সাধক বিশ্ব জগত ও আত্ম জগতের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব স্বীকার করেন না। তিনি তখন এমন একটা চিন্ময় লোকে আরোহণ করেন তখন তিনি ভোক্তা নন, পূজারী নন, তিনি ভাবলোকের এক দীপ্তিময় চৈতন্য। মিষ্টিক সাধকের বিচরণ ক্ষেত্র ভাবজগত তাই সংসারবিমুখ বৈরাগী জগত তাদের কাছে শ্রেয়। অবিনশ্বর সত্য ও সুন্দরের প্রতি তাদের থাকে ঐকান্তিক টান; আমরা লালনের মাঝে খুঁজে পাই প্রকৃষ্ট মাত্রায়। লালনের মতো হাফিজ, রুমী, গ্যেটে, এমনকি আমাদের নজরুল, রবীন্দ্রনাথেরাও একই ধারার পথিক। সীমার মাঝে অসীমের রূপ সন্ধানে ধ্যানি ছিলেন তারা। মনের মানুষ যে মনে বসবাস করে সেটা নিবেদিত চিত্তে উপলব্ধি করে সাধনায় অত্মসমর্পণ করে মিলিত হতে চান তার সঙ্গে। লালন আত্মতত্ত্ব অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাধনার উচ্চস্তরে আরোহণ করেন তিনি পরম রতœ লাভ করেন। তিনি চিনতে পারেন মনের মানুষকে; তার কথায়- ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে দিব্য জ্ঞানি সে হয়েছে।’ মনে যেহেতু সেই পরম পুরুষের বাস সেখান থেকে দেহও বাদ যায় না লালনের ভাষায়- ‘যে লীলা ব্রহ্মা-ের মাঝার সে লীলা ভা- মাঝার’ এখানে লালন ভা- বলতে মানবদেহ বুঝিয়েছেন অন্যদিকে মানবদেহতেও অজানা জগতের যে লীলা চলে তা বলে গেছেন- ‘এ এক আজব কুদরতি/ আঠারো মোকামের মাঝে/জ্বলছে একটা রূপের বাতি।’ এই রূপই লালনের চৈতন্যে অরূপ হয়ে প্রপঞ্চ নিয়ে তাকে ভাব সাগরে নিমজ্জিত করে। রবিঠাকুর হয়ত এ থেকেই রূপ সাগরে ডুব দিয়েছিলেন অরূপ রতন আশা করে। নিজেকে জানলে আত্মাকে জানা যায় হাদিসের ভাষায় যেমন ‘মান আরফা নাফসাহ ফাকাদ আরাফা রাব্বা হু।’ উপনিষদে বলা আছে আত্মা নং বিদ্ধি আর সক্রেটিস বলেছেন ‘নো দাই সেলফ’ বা নিজেকে জানো। এই নিজেকে জানবার এক দুর্দম নেশায় লালন বুঝতে পারেন নিজেকে চেনা মানে সেই অচেনাকে চেনা; লালনের গানে তাই অচেনাকে চেনা আর জানার ঘোর কাটে না কোন কালেই। তার আক্ষেপ- ‘হাতের কাছে যার ভবের হাটবাজার/ধরতে গেলে হাতে পাই না তারে।’ লালন তার জীবদ্দশায় অসংখ্য গান লিখে গেছেন। গানগুলোকে গবেষকরা বিভিন্ন ধারায় ভাগ করেছেন। তার গানে রয়েছে যেমন অচিন, অজানা , অপূর্ব কোন সুরের মূর্ছনা, তেমনি আছে মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, সমাজ-সংস্কারের বীজ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতির ভেদাভেদ ভুলে এক এমন সমাজের চিন্তা যেখানে সবাই সমান সম্মান পাবে। তার গানের গূঢ় দর্শন সাধারণ মানুষকে যেমন করেছে বিমোহিত তেমনি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে কাজী নজরুলের মতো বহু খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, গবেষককে আদিষ্ট করেছে অপার মহিমায়। লালনের গানের নানামুখী ব্যাখ্যা হয় যা আগে বলা হয়েছে; তবে লালনের গান আমাদের দৃষ্টির বাইরে যে অজানা আরেক মাত্রার কুহকী এক জগত আছে সেখানে টেনে নিয়ে যায়। লালনের আধ্যাত্মবাদ তার নিজের তৈরি আধ্যাত্মবাদ- যেখানে তার গান অনির্বচনীয় এক নিগূঢ় উপলব্ধিতে মহীয়ান-যেখানে আত্মজাগরণ আছে আছে অনুসন্ধান; পাওয়ার ভেতর যে না পাওয়া থাকে তা পাবার বিপুল তৃষ্ণা। তাই তার গানে চলে গুপ্ত, সুপ্ত আর নির্লিপ্তের অন্বেষণ। লালনের আরশি নগরে নিজেকে দেখা যায়; দেখা যায় শুধু অবয়বটুকু কিন্তু অন্তরাত্মা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে- সে আর লালন এক ঘাটে রয় তবু লক্ষ যোজন দূরে। লালনের গান যেন বলতে চায় স্রষ্টা বিশ্ব প্রকৃতিতে বিলীন আছেন অদৃশ্য হয়ে তবু তার নানা ব্যঞ্জনা আছে সে তার সৃষ্টির নানা খেলায় আভাস দেয় কিন্তু তাকে ধরা যাবে না কোন মতেই। সে নানা অবর্ণনীয় রূপে কথা কয় কিন্তু সে ধরা দেয় না- তাই লালন কাতর হয়ে বলেন ‘নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনমভর মিলে না/ খুঁজি তারে আসমান জমি/আমারে চিনি না আমি/একি বিষম ভুলে ভ্রমি।’ গানের শেষটুকু না পাওয়ার বেদনায় আরও মর্মন্তুদ ‘হাতের কাছে হয় না খবর/ কী দেখতে যাও দিল্লি লাহোর।’ সিরাজ সাঁই তাই লালনকে বলে লালন তোর এই ভ্রম খুব সহজে যাবে না। লালনের সেই অচেনাকে চেনার চেষ্টা লালনকে নিয়ে যায় আরও গভীর আত্ম-উপলব্ধিতে- লালন বুঝতে পারে অপর দর্শনের পূর্বে তার আত্ম-দর্শন দরকার। তাই লালনের প্রায় প্রতিটা গানে আমরা নিজেকে জানবার ব্যর্থ চেষ্টা দেখি। স্রষ্টা মানব অস্তিত্ব জুড়ে তার ছায়া ফেলে রেখেছেন তার কায়া বোঝা ভারি মুশকিল। শুধু তাই নয় স্রষ্টা মানব অন্তরেও টেনে রেখেছেন অজানার সীমাহীন আড়াল- যত কাছে যাওয়া যায় অসীম তার বিরাট অসীমতায় আরও বিলীন হয়ে যান। যেমন রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি।’ কীভাবে জীবনরূপী অচিন পাখি আমাদের দেহে বাসা বাঁধে তার উত্তর লালনের ধরাছোঁয়ার বাইরে- লালন বিচলিত এই সীমাহীন অজানায় : ‘কী এক অচিন পাখি পুষলাম খাঁচায় না হলো জনম ভর তার পরিচয়।’ এটা সত্য যে লালন কোন বাহ্যিক বিষয় নয় অন্তর্মুখী ভাবধারাই তার সঙ্গীতের পরিচয়। এন্তাজ উদ্দীন এ প্রসঙ্গে বলেন- আকার থেকে নিরাকার এবং আত্মা থেকে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভের উপায় জানতে চাওয়া লালনের গানের একটা বৈশিষ্ট্য। ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে পরমাত্মার অনুসন্ধান তার গানের একটা বিষয়। সহজ সরল সঙ্গীতের মাধ্যমে রহস্যের অতলান্তে গমন এই হচ্ছে লালনের গানের মর্মবাণী। শুধু গানের ঝঙ্কারে নয় অদ্ভুত এক সুর আর দ্ব্যর্থক কথা লালনের গানকে টেনে নিয়ে আত্মদর্শন থেকে মানব মনের নানা জিজ্ঞাসার দ্বার খুলে দেয়। তার গানে আছে মুক্তির স্বাদ; আছে মানবের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার অনেক পথ। তাই দিনে দিনে লালন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন হয়ে উঠছে তার অনেক দিনের পুরনো সুর আর কথা। তবে এ কথা সত্য অনেকেই লালনের দেহতত্ত্বের দিকটায় বেশি আলোকপাত করেছেন কিন্তু তার আত্ম-তত্ত্বের দিকে ততটা আলোচনা করা হয়নি। লালনের আত্ম-তত্ত্ব হচ্ছে নিজেকে জানবার বাসনা; নিজের মনের খোঁজ আর এই বাসনা যখন অপূর্ণ থাকে তখনই লালনের থেকে বেরিয়ে আসে গভীর ব্যথার সুমিষ্ট গান। এমনি একটি গানে লালন পেয়েও পান না তার নিজেকে- ‘এই মানুষের আছে, রে মন, যারে বলে মানিক রতন, লালন বলে পেয়ে সে ধন পারলাম না চিনিতে।’ তাহলে এই অধরা কে কীভাবে ধরা যাবে; একি শুধুই প্রপঞ্চ, শুধুই মায়া? লালন বলে এর জন্য আমাদের আত্ম জিজ্ঞাসা করতে হবে তাই লালনের গানে যেমন নিরাশা আছে নির্বস্তুর প্রতি মোহ আছে, আছে ফিরে ফিরে আসা আত্ম-জিজ্ঞাসা। গুরু ভক্তির মাধ্যমে আছে মনের মানুষকে পাবার তীব্র আকাক্সক্ষা। আর গভীর সাধনার দ্বারা এই অচিনকে চেনা যায় যে দেহের খাঁচায় থাকে; কিংবা যার নির্দেশে তার আনাগোনা এই দেহের ভেতর। লালন বলেন কিরূপ সাধনের বলে অধর ধরা যায়। নিগূঢ় সন্ধান জেনে শুনে সাধন করতে হয়। এই সাধনার জন্যই লালনের গান হয়ে যায় ভক্তি সঙ্গীত এ গান শুধু গেয়ে গেয়ে মানুষের মনে তৃপ্তি আনা নয়; এ গান স্রষ্টার প্রতি নিজেকে নিবেদন; এক সাধনা; স্রষ্টাকে জানবার করুণ আর্তি। লালন তার গানের তরী বেয়ে এই উপলব্ধিতে উপনীত যে সে মহান স্রষ্টার কৃপায় আমরা কত ছোট্ট এক সৃষ্টি কারণ কীভাবে লালন স্রষ্টার অপার মহীমা বুঝবে সে তো নিজেই নিজেকে চিনে না; তাই অধর স্রষ্টা অধরাই থেকে যায় অসীম নীরবতা নিয়ে; আর এ কথা বারে বারে ধ্বনিত হয় লালনের নিজেকে জানবার বিফলতার মাঝ দিয়ে। লালন তো নিজেকেই চিনতে ব্যর্থ তাহলে কীভাবে নিগূঢ়কে অগমকে জানবেন- আপনারে আপনি চিনিনে দিন-দোনের পর যার নাম অধর তারে চিনব কেমনে? সিরাজ সাঁই কয় লালন রইল, জন্ম অন্ধ মন-গুণে। নিজিকে চেনা মানেই স্রষ্টাকে চেনা কারণ স্রষ্টা তার নিজ অসীম জ্ঞান আর অপার ভালবাসা দিয়ে মানুষকে সৃজন করেছেন; মানুষের মাঝে যে স্রষ্টা তার নিঃশেষ ভালবাসা নিয়ে বিরাজ করে। লালনের উপলব্ধি- আপনারে চিনতাম যদি হাতে মিলতো অটল নিধি মানুষের করণ হতো সিদ্ধি। লালনের মতে দিব্য জ্ঞান দিয়ে আমরা নিজেকে চিনতে পারি। কিন্তু ক্ষুদ্র আমিত্বের পেছনে ছুটে সবাই এই পৃথিবীর চাওয়া পাওয়া হিসাব নিকাশে অন্ধ হয়ে থাকে- সিরাজ সাঁই তাই লালনকে বলে সে তার নিজ মন-গুণেই জন্ম অন্ধ থেকে গেল। এই অন্ধত্ব না দেখতে পাবার অন্ধত্ব নয় এ অন্ধত্ব নিজেকে না চিনবার আর জানবার করুণ ব্যর্থতা। কারণ এই ব্যর্থতাই স্রষ্টার অপার মহীমা, অসীম ভালবাসা , মহত্ত্ব কী তা আমাদের ছোট্ট জ্ঞানে জানবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন রবীন্দ্রনাথ তার ‘সাধনা’ গ্রন্থে বলেন ‘তার মতো চরম দুর্ভাগা আর কেউ নেই যে এই পৃথিবীতে স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের একটুও আঁচ করতে না পারে।’ মনের কলুষতা, পঙ্কিলতা, মোহ এবং কামকে বশে এনে দেহ ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে আমরা নিজের আমিকে আমার মনের মানুষকে জানতে পারি। বর্জন ও ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে অপারকে জানার চেষ্টা করতে পারি। পরমাত্মাকে পাবার চেষ্টাই একজনকে শুদ্ধ মানুষ করে তোলে। সেই মানুষের ভক্তি সফল যে নিষ্ঠাবান তাই লালন বলেন- সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার/ মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার। আর এটা হতে পারে প্রার্থনার মাধ্যমে বা অন্যান্য ধর্মীয় ধ্যান সাধনার মাধ্যমেও। অজানাকে জানার প্রথম ধাপ নিজেকে জানা এর পরে ধ্যান থেকে জ্ঞান, জ্ঞান থেকে অনন্তের পথে যাত্রা করা যায়। এটা সবার পক্ষে যেমন সম্ভব নয় আবার অসম্ভবও নয়; আবার সবার মনে এটা সমানভাবে উদ্ভাসিতও নয়। কিন্তু লালন এটা জানে সে তার অজানাকে জানবার চেষ্টায় কখনও কখনও আর দশটা মানুষের মতো নিজেকে ছেড়ে বাইরের জগতের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে- তাই লালন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করেন- রতœ যে পায় আপন ঘরে সে কি বাইরে খুঁজে মরে? না বুঝে লালন ভেড়ে দেশ বিদেশে ধায়। নজরুল, রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ আবেশে লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাদের অনেক গানে নিজেকে জানবার তাড়না দেখান লালনের প্রভাবে। লালনের গানের দ্যোতনা খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের গানে- রবীন্দ্রনাথও লালনের মতো রূপ সাগরে ডুব দেন অরূপ রতন আশা করে। তারাও তাদের অনেক গানে মনের মানুষের সন্ধান করে গেছেন। লালনের মতো রবীন্দ্রনাথ বলেন ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তায় সকল খানে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন দেবতা অনুসন্ধানের খোঁজ হয়ত এসেছিল লালনের গান থেকেই। অনেকের মতের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মন বেড়ি দিতাম তার পায়’ এই কালজয়ী গানটি থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার আগমন। তবে এ কথা সত্যি রবীন্দ্রনাথ লালনকে শিক্ষিত সমাজে পরিচিত করিয়ে দেন। লালনের গভীর তাৎপর্যময় মরমী গান রবীন্দ্রনাথকে শুধু আলোড়িত করে না রবীন্দ্রনাথ এর থেকে দারুণভাবে প্রভাবিতও হন। লালন তার দর্শনে নিজ আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে মিলনের যোগসূত্র আবিষ্কার করতে গিয়ে দুই ‘আমি’র প্রসঙ্গ এনেছেন। ক্ষুদ্র আমি (জীবাত্মা) এবং বৃহৎ আমি (পরমাত্মা)। ক্ষুদ্রাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে উন্মুখ। রবীন্দ্র সাহিত্যেও এক বিরাট অংশ জুড়ে এই মিলন বাসনা পাওয়া যায়। আবার রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে অচিন সেই রূপের ইঙ্গিত দেন। ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানেরও পাড়ে/ আমার সুর গুলি পায় চরণ আমি পাইনা তোমারে’ আবার ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না’ কিংবা আমি কান পেতে রই /ও আমার আপন হৃদয় গহন- দ্বারে বারে বারে/ কোন গোপন বাসীর কান্না হাসির গোপন কথা শুনিবারে।’ গানগুলো আমাদের মাঝে এক অপার্থিব অনুভূতির জন্ম দেয়। লালনের সুবিখ্যাত গান ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর সেথা পরশী বসত করে/ আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে।’ গানটিতে প্রতীকের অসামান্য ব্যবহার আছে- যেমন আছে পরাবাস্তব ব্যঞ্জনা। ‘গেরাম বেড়ে অগাধ পানি/ নাই কিনারা নাই তরণী পারে/ বাঞ্ছা করলাম দেখব তারে কেমনে আমি যাই রে’- লালনের অসমাপ্ত আকাক্সক্ষার স্বাক্ষর বহন করে। অজানার দেখা না পাবার আকুতি আবার ফিরে আসে গানটিতে ‘পড়শী যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সবি যেত দূরে।’ কিন্তু তা তো সম্ভব হবে না পড়শী যে ইন্দ্রিয়াতীত অনুভব মাত্র। লালন তারও ইঙ্গিত দেন- ‘কি বলব পড়শীর কথা / হস্তপদ স্কন্ধ মাথা নাইরে/ ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর ক্ষণেক ভাসে নীরে।’ হস্তপদ স্কন্ধ মাথা নাইরে কথাগুলো অন্যরকম এক চতুর্মাত্রিক অশরীরী জগতে নিয়ে যায় আমাদের। লালন দর্শনের উপলব্ধি হচ্ছে স্রষ্টার বাস সৃষ্টিতেই কিন্তু বৃহদ্মাতা জীবাত্মার মাঝে গুপ্ত হয়ে থাকে তাকে পেতে গেলে সাধারণ জ্ঞান দিয়ে হয় না দিব্য জ্ঞান লাগে যা জানা লালনের পুরো জনমের সাধনা; তাই লালন বলেন- ‘সে আর লালন একখানে রয় তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।’ এই কথাগুলো লালনের দ্বৈত সত্তার ওপর বিশ্বাসের পরিচয়বাহী। তবে এই দুই সত্তা যে সমান্তরাল নয় তারও উল্লেখ আছে তার দর্শনে। মানবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলন চায় কিন্তু সে চাওয়া তাতে লীন হয়ে হয়ে যাবার জন্য নয়। লালনের কথায় আমি চিনি খেতে চাই কিন্তু চিনি হতে চাই না। আরেক গানে লালন আবার তার এই দর্শনের কথা বলে অচেনাকে না পাবার ব্যর্থতা তুলে ধরে- ‘এই মানুষে মানুষ রতন/ মানুষের হলো না যতন/ লালন বলে পেয়ে ধন/ পারলাম না চিনিতে।’ লালনের গানে সাধারণ অর্থেই ধরা হয় রহস্যময়তার প্রতীক হিসেবে কিন্তু আধ্যাত্মিকতা বিচারে অধর; লালন যাকে অধর বলে তাঁকে বুঝতে না পারার অক্ষমতাই লালনকে তাড়িয়ে ফেরে। তাই তার গান শুধু গান থাকে না দর্শন হয়ে যায় যার মাঝে মানবজন্ম, তার অস্তিত্ব, তার অজ্ঞাত পরিসমাপ্তি লালনকে গভীরভাবে ভাবায়। লালন পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের মাধ্যমে তার সমস্থ না পাওয়া পূরণ করতে চান। এই পরমাত্মাই ধীরে ধীরে লালনের গানে অচিন কেউ হয়ে যায়। কিন্তু লালন শুধু পরমাত্মার মাঝেই সীমাবদ্ধ নন তিনি এই পৃথিবীতেও চেনার মাঝে অচিনের দর্শন পান ধ্যানের গভীরে গিয়ে। আত্ম-দর্শনই অচেনা, অজানা, অদর্শনকে জানাতে পারে। কিন্তু খুব সামান্য চেষ্টায় কি পরমাত্মাকে পাওয়া যায়? লালন রহস্য রেখে বলেন- ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা / যার বেদে নাই রূপরেখা।’ তার না চেনার এই ধারা চলতে থাকে অবিরত- ‘হাতের কাছে যার / ভবের হাট বাজার/ ধরতে গেলে হাতে পাই না তারে’ আবার আরেক গানে বলেন ‘আপন ঘরের খবর হয় না / বাঞ্চা করি পরকে চিনা।’ রবীন্দ্রনাথ তার এক গানে এ কথাই যেন বলতে চানÑ ‘এ তার বাঁধা কাছের সুরে / ঐ বাঁশি যে বাজে দূরে।’ তাই শত চেষ্টাতেও লালনের কাছের মানুষ দূরেই থেকে যায়। কারণ আমরা নিজেকেই চিনি না- যেমন লালন ব্যর্থ নিজেকে চিনতে ‘যার আপন খবর আপন আর হয় না/ আপনারে চিনতে পারলে / পাবি সেই অচিনারে চেনা।’ রহস্য লালনের গানের এক বড় অনুষঙ্গ; তার অচিন পাখি, অচিন জন, অচিন মন আর চেনার মাঝে যে চির অচিনের বাস তা ভেদ করাই যেন লালনের গানের এক বড় উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। যেমনটি তার পাখি প্রতীক দিয়ে বারবার অনুরণিত ‘কার খাঁচা কেবা পাখি/কার জন্য মোর ঝরে আঁখি/ আমার এ খাঁচায় থেকে/ আমারে মজাতে চায়’ অথবা ‘হায় চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি/ পাখি ভেদ-পরিচয় দেয়না মোরে/ ঐ খেদে ঝরে আঁখি।’ লালনের নিষ্ফলতা, বিফলতা লালন বলে যান অকপটে- ‘লালন মরল জল পিপাসে/ থাকতে নদী মেঘনা।’ এটি আমাদের এসটি কোলরিজের বিখ্যাত ‘ ডধঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎু যিবৎব / অষষ ঃযব নড়ধৎফং ফরফ ংযৎরহশ/ ডধঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎু যিবৎব/ হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ’-এর সঙ্গে সাযুজ্য খোঁজায়- দু’জনাই অতি-প্রাকৃত জগতে ডুবে জান আর বিফলতা দেখেন মানব দর্শনে; এক ধরনের শুষ্কতাও তাদের আড়াল করে রাখে সজীব জগত থেকে। আনসান্ট মেরিনার যেমন আজব মানুষ হয়ে বাহ্যিক জগতের মাঝে এক অন্তর্গত জগতের সন্ধান পান লালনও তেমন এক আজব মানুষের সন্ধান পান এ জগতে- সে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর অচিন কোন কোনে। লালনের ভাষায় ‘আছে দিন দুনিয়ায় অচিন মানুষ একজনা’ এটি সত্যি আমাদের অতিপ্রাকৃত এক জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায়- কোন সে অচিন জন লালন যার ইঙ্গিত দেন; এটি রহম্যময় লালনকে আরও রহস্যময় করে তোলে। কিন্তু লালন যখন বলেন ‘নিরাকারে জ্যোতির্ময় সে’ তখন আমাদের আপাত জ্ঞানের সীমানায় ধরা দেয় তার দুর্বোধ্য দর্শন। শূন্য এ জগতে পূর্ণতা অন্বেষণ করাই লালন ফকিরের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। আত্মতত্ত্ব বিচার করে, রিপুকে নিয়ন্ত্রণে এন, কাম, লোভ আর জাগতিক অনাসক্তীর ও ধর্মীয় সাধনার মাধ্যমে নাজাত ও নির্বান লাভ করে সেই অচিনের আশা মিটবে পাওয়ায় নয় অদৃশ্য দেয়া আর নেয়ায়। আমিত্বকে ত্যাগ করে, আধ্যাত্ম জগতে নিজেকে সমর্পণ করে, ভাবের জগতে ডুব দিয়ে পাওয়া যাবে না পাওয়াকে। লালন তাই মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের ওপর অনেক গান লিখে গেছেন; না পাওয়ার অতৃপ্তি মানুষকে করে তুলতে পারে অপূর্ণ দ্বিধাগ্রস্ত-সত্তা সেখান থেকে নিস্তার পাবার উপায় হচ্ছে ধর্মে আত্ম নিয়োগ- লালন বুঝতে পারেন- ‘সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার/ ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।’ আমাদের নফসের একটা সাধারণ প্রবণতা বিপথে যাওয়- লালনের ভাষায়- ‘নাই আমার ভজন সাধন / চিরদিন কুপথে গমন।’ তাই নিজের মনের জাগতিক লোভ, লালসা পরিত্যাগ করলে অচেনাকে চেনা যায় লালনের উপলব্ধি ঘটে ‘আপনারে ফানা করে / অধরে মেশে তারা/ মন যদি আজ হওরে ফকির নাও জেনে সে ফানার ফিকির/ ধরা অধরা।’ লালন অচেনাকে চিনতে গিয়ে, অরূপকে জানতে গিয়ে জীবনের জন্য মূল্যবান দর্শন লাভ করেন। আজ পৃথিবীব্যাপী যে হিংসা, হানাহানি, লোল, রিরংসা, মানুষে মানুষে ঘৃণার বিষবাষ্প তা লালনের গানের বাণী আর তার দেখানো ত্যাগের মহীমা পালন করলে নিশ্চয়ই অনেকাংশে কমে আসবে- মানুষের মাঝে পশুপ্রবৃত্তি লোপ পাবে আর এই পৃথিবী হবে সকলের জন্য এক সুখময় বাসস্থান।
×