ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক হারেই তিন বছর নির্বাসনে

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১২ অক্টোবর ২০১৬

এক হারেই তিন বছর নির্বাসনে

শেষ পেরেকটিও ঠুকে গেল বাংলাদেশের ফুটবলে। ‘লাইফ সাপোর্টে’ থাকা দেশের ফুটবল এখন পৌঁছে গেছে ‘কোমায়’। ভুটানের কাছে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের প্লেঅফের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ হেরে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছেন মামুনুল, মামুন, এমিলিরা। এর ফলে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে খেলার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমাহীন এই ব্যর্থতার কারণে আগামী তিন বছর আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতে পারবেনা লাল-সবুজের এই দেশ! ভুটানকে একসময় বলে-কয়ে আট-দশ গোল দিত বাংলাদেশ ফুটবল দল। সেই দলকে এখন নিজ দেশে হারাতে পারে না ফুটবলাররা। শুধু তাই নয়, ১০ অক্টোবর প্রথমবারের মতে ভুটানের কাছে হেরেছে (৩-১) বাংলাদেশ। সাফ ফুটবলে অমার্জনীয় ব্যর্থতা, মালদ্বীপের কাছে ৫ গোল হজম, ভুটানের কাছে পরাজয়ের কারণগুলো এখন পর্যালোচনার সময় এসেছে। স্বাগতিকরা পেনাল্টি মিস না করলে ভুটানের কাছে হারের ব্যবধানটা আরও বড় হতো। এসব পরিসংখ্যান লজ্জার চেয়েও বেশি কিছু। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এখনও ঘুমিয়ে থাকতে পারেন! তার ঘুম ভাঙবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দিহান ফুটবলপ্রেমীরা। ভুটানের কাছে হারের পর দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। মিডিয়া হাউসগুলোতে আসতে থাকে ফোনের পর ফোন। অমার্জনীয় এই ব্যর্থতাকে বাংলাদেশের লজ্জা দেখছেন না ক্রীড়াপ্রেমীরা। তাদের মতে, এ লজ্জা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের। এই সালাউদ্দিনই ২০১২ সালে ভিশন ২০২২ ঘোষণা করেন। যার মূল লক্ষ্য ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে এর চেয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর হতে পারে না বলে মতামত ফুটবলপ্রেমী ও বিশ্লেষকদের। বাফুফে সভাপতি টানা নয় বছর মসনদে আছেন, অথচ একন পর্যন্ত একটা দল দাঁড় করারতে পারেননি। কোন কোচকেও দলের সঙ্গে থিতু করতে পারেননি। এসব কারণে দেশের ফুটবল এখন মৃতপ্রায়। এই অবস্থাকে এক কথায় বলা হচ্ছে তলাবিহীন ঝুড়ি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশের ফুটবলে এতটা করুণ সময় আর আসেনি। ৪২ বছরের ফুটবল ইতিহাসে এখনই সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ বাংলাদেশ ফুটবল দল। এক সময় খেলা বাদ দিয়ে ফুটবলাররা থাকতে রাজপথে, তখনও ফুটবল এতটা মিয়ম্রাণ হয়নি। তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে পাত্তা দিত না বাংলাদেশ। অথচ আধুনিক এই যুগে প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়েও ফলাফল ‘শূন্য’। সীমাহীন এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম লেগে ড্র করায় বাছাইপর্বে উঠতে কমপক্ষে ১-১ গোলের ড্র করার প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। উল্টো ভুটানের কাছে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম হারের লজ্জায় ডুবেছে মামুনুল, রনিরা। থিম্পুর চ্যাংলিমেথাং স্টেডিয়ামের টার্ফে ম্যাচের শুরু থেকেই ভুটান ছিল আগ্রাসী। তপু বর্মণ, রায়হান হাসান, আতিকুর রহমান মিশুর রক্ষণভাগ তাদের রুখতে পারেনি। সময় যত গড়িয়েছে, মামুনুলরা ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েছেন একটু একটু করে। হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস, শাখাওয়াত হোসেন রনি মাঝ মাঠ থেকে বলের জোগান পাননি। দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা গুছিয়ে খেলার চেষ্টা করে বাংলাদেশ। প্রথমার্ধেই দুই গোলে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ এক গোল ফিরিয়েও দেয়। এরপর আরেকটি গোল হজম করে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। যে কারণে ম্যাচে ফেরার স্বপ্নও স্বপ্ন রয়ে যায়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভুটানের কাছে হারের লজ্জা নিয়ে আসতে হয়। অথচ ভিশন ২০২২ ঘোষণা করে ফুটবলকে আকাশে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাফুফে বস সালাউদ্দিন। এতদিন পর এসে মনে হচ্ছে, আদতে সেটা শুধু ঘোষণাই, বলার জন্য বলা। সত্যিটা হচ্ছে, ফুটবলকে এতটুকু এগিয়ে নিতে পারেননি সালাউদ্দিন এ্যান্ড গংরা। এখন কাতার বিশ্বকাপ খেলা তো দূরে থাক, দেশেই ফুটবল জীবিত থাকে কিনা সন্দেহ! সাম্প্রতিক ছেলেরা মাঠে তো হেরেছেনই, উপরন্তু শৃঙ্খলা ভেঙে ক্ষতি করেছেন জাতীয় দলের। ছেলেদের নিয়ে তাই বাফুফে সভাপতির ‘ভিশন ২০২২’ কোমায় চলে গেছে। ছেলেদের নিয়ে এখন বিশ্বকাপ খেলানোর চিন্তা করাটা বোকামি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। উপরুন্ত মেয়েরা যে সাফল্য পাচ্ছে তাতে তারাই হয়ত স্বপ্নপূরণ করতে পারবে। এখন যে অবস্থা তাতে মূল জাতীয় দল নিয়ে স্বপ্নের নাটাই হয়ত ঘোরাবে না বাফুফে। কেননা মূল জাতীয় দলকে বিশ্বকাপে খেলতে হলে প্রথমে এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠতে হবে। সেটা অনেক দূরের পথ। তবে গত কয়েক বছরে দেশের বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে এমনই বিপ্লব ঘটেছে যে, কোন বাধাই আর বাধা মনে হচ্ছে না বাফুফের কাছে। আজকের কিশোরীরাই জাতীয় দলের হাল ধরবে ভবিষ্যতে। ছেলেদের চেয়ে এখন মেয়েদের দিকেই বাফুফের বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন যে অবস্থা তাতে, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলবে কথাটা শুনলে সবাই হেসে উড়িয়ে দেবে। দেয়ারই কথা। বর্তমান বাস্তবতায় এশিয়ার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছানোও বাংলাদেশের কাছে দিল্লী বহুদূরের মতো। অথচ বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন ছিল সালাউদ্দিনের চোখে। যখন ভিশন ২০২২ ঘোষণা করেছিলেন তখন সালাউদ্দিন বলেছিলেন, কোটি টাকার সুপার কাপ করার ঘোষণা যখন দিলাম, অনেকে আমাকে পাগল বলল। মেসিসহ আর্জেন্টিনা আসার আগে লোকজন বলেছে, আমি অবাস্তব কথাবার্তা বলছি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠ দেখে মেসি নাকি খেলতেই নামবে না। কিন্তু মেসি এসেছে, আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচ হয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি। তাই ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। ওই সময় সালাউদ্দিন বলেছিলেন, আমি ফুটবলপাগল মানুষ। পাগল বলেই মনে করি, কোন কিছুই অসম্ভব নয়। যখন বলেছিলেন তখনই বাস্তবতা ছিল এমনÑসাফ ফুটবলে সেমিফাইনালেই উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ হয়ে গেছে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের নাম। আগে বিশ্বকাপ বা এশিয়া কাপের বাছাইপর্বে খেললেও এখন প্রাক-বাছাইয়ে নামতে হয়। এসব কোন কিছুই সালাউদ্দিনের অজানা নয়। তারপরও তিনি বলেছিলেন, বর্তমান প্রজন্ম নয়। আগামী প্রজন্মই আমাদের বিশ্বকাপে নেবে, এটা আমার বিশ্বাস। তার এই বিশ্বাস এখন গুড়েবালি।
×