ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেতৃত্ব-নৈপুণ্যে অতুলনীয় মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১২ অক্টোবর ২০১৬

নেতৃত্ব-নৈপুণ্যে অতুলনীয় মাশরাফি

নিন্দুকের মুখে ছাই ঢেলে দিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। গত মার্চে ভারতে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলে তার থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে- ‘এই দলটিতে মাশরাফির ভূমিকা কি, তিনি কি করছেন?’ সমালোচকদের অনেকেই বলছিলেন আসলে মাশরাফি শুধু অধিনায়কত্ব করার জন্যই আছেন, কিন্তু পারফর্মার হিসেবে নয়। সমালোচকদের জবাব তিনি একক নৈপুণ্যে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দলকে জেতানোর মাধ্যমেই দিয়েছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে শক্তিধর দলে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের বর্তমান স্কোয়াডে তিনিই সবচেয়ে বেশি বয়সী ক্রিকেটার। ৩৩ ছুঁয়েছেন মাত্র কয়েকদিন আগেই। চারদিন আগেই ৩৩তম জন্মদিন গেছে- বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সফলতম এ অধিনায়ক তেমন কোন সাড়ম্বর উদযাপন করেননি। কোন উপহার পেয়েছেন কিনা সেটাও অজানাই থেকেছে। কিন্তু পুরো বাংলাদেশকে তিনি বিরাট এক উপহার দিয়েছেন ব্যাটে-বলে দুরন্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে দলকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতিয়ে। ২৯ বলে ৪৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলার পর বল হাতে আবার ২৯ রানে নিয়েছেন ৪ উইকেট। অলরাউন্ডার মাশরাফির কল্যাণেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে ১-১ সমতা এনেছে বাংলাদেশ দল। এটাই প্রমাণ দিয়েছে দুই পায়ে আটটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের পরেও কি কারণে তিনি বাংলাদেশ দলে? আর নেতৃত্ব নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন তোলার তো সুযোগই নেই। ব্যাটে-বলে-ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত মাশরাফি অধিনায়ক হিসেবেও টানা ৬ ওয়ানডে সিরিজ জিতিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই শুধু নয়, পুরো জাতির কাছেই তাই ‘মহানায়ক’ মাশরাফি। ফিটনেস সমস্যার কারণে ২০১১ সালে প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক হওয়া বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারেননি মাশরাফি। কারণ ক্যারিয়ারজুড়ে যে ইনজুরির সঙ্গে যুদ্ধ সেটা ছিল বিশ্বকাপের আগেও। ক্রিকেট ভালবাসা মাশরাফি কেঁদে ফেলেছিলেন বিশ্বকাপ খেলতে না পারার আক্ষেপে। কারণ, অনেকবার ইনজুরি নিয়েও মনের জোরে খেলেছেন। ৩৩ বছর পেরোনো মাশরাফি কি বুড়ো হয়ে গেছেন? তিনি কি ঠিকভাবে ফিল্ডিং, বোলিং করতে পারেন না? ফিটনেস টেস্ট কিন্তু অন্যরকম কথা বলে। ফিটনেস ক্যাম্প যখন চলে সে সময় এখনও দলের তরুণ-নবীনদের ছাড়িয়ে যান টেস্টে। অথচ গত বছরও কিছু মানুষ বলাবলি করছিল- অবসরে যাওয়ার সময় হয়েছে মাশরাফির, ১৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটের সঙ্গে আর কত? কিন্তু এই মাশরাফি তো ফুরিয়ে যাননি, এখনও আছেন আগের মতোই। সেটা করে দেখালেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। সামর্থ্য, সক্ষমতা কিংবা জয় করবার উপযুক্ততা এখনও শেষ হয়নি- শুধু সময়টা গড়িয়ে গেছে। এই মাশরাফির অবসর নিয়ে কথা বলার কিছুই নেই। মাশরাফি যতদিন থাকবেন ততোদিন অন্তত ভুলক্রমে পথ ভোলার সুযোগ নেই টাইগারদের। ক্রিকেটের জন্য যে অফুরান ভালবাসা ও আবেগ সেটাকে মাশরাফি ব্যক্তিগত জীবনেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিংবা তার ক্রিকেটের প্রতি এমন আবেগটা ছুঁয়ে গেছে তার পরিবারকেও। তাই তো তার ছোট্ট মেয়েটা পর্যন্ত ক্রিকেট নিয়েই হাসি-কান্নায় ভাসে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচ জয়ের পর সংবাদ সম্মেলন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় তিন সাংবাদিকের সঙ্গে মাশরাফির কথা হচ্ছিল। সে সময় তিনি বলছিলেন, ‘প্রথম ম্যাচটা হারার পর আমার মেয়েটা এসে আমাকে মারছিল এবং প্রশ্ন করছিল কেন হারলাম? আজ (রবিবার) জিতেছি, আমার মেয়েটার চেয়ে খুশি আর কেউ হতে পারবে না। এ ম্যাচটা ওর জন্য জেতাই লাগতো নাহলে অনেক কষ্ট পেত!’ মাশরাফি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বাংলাদেশ দলে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন। পারফর্মেন্সের কারণে কখনই বাদ পড়েননি ২০০১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর থেকে। অন্য কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে দলে থাকা নিয়ে কোন যুদ্ধও ছিল না কোন সময়, বাংলাদেশ দলে তিনি ছিলেন অটোমেটিক চয়েস। ১৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এভাবেই। যার মধ্যে প্রায় সবমিলিয়ে ৫ বছরই মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে- যুদ্ধটা ছিল শুধু নিজের শরীরের সঙ্গে, দুর্ভাগ্যজনক ইনজুরির সঙ্গে। ফেরার চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, মুখরোচক খাবারগুলোও এড়িয়ে যেতে হয়েছে ম্যাচ খেলার ফিটনেস ফিরে পাওয়ার জন্য। সবকিছু ছেড়ে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টার অন্ত রাখেননি, ঘাম ঝরিয়েছেন অনুশীলনে। অনবরত চেষ্টা, ইচ্ছাশক্তি, ভালবাসা এবং ভাল কাজের প্রতিফলন অবশ্যই পুরস্কার হয়ে আসে। নিয়মিত দারুল লাইন-লেন্থে মিতব্যয়ী বোলিং করে সেটার পুরস্কার জুটল তার ইংলিশদের বিরুদ্ধে। ফিটনেস লেভেলটা অবশ্য দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলার জন্য উপযুক্ত আর হয়নি। কারণ দীর্ঘক্ষণ বোলিং করার মতো সাপোর্ট তার ক্ষতবিক্ষত হাঁটুটা দেবে না। তাই ফিজিও, ডাক্তারদের পরামর্শে ২০০৯ সালের পর থেকে আর টেস্ট ম্যাচ কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেননি তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একমাত্র অর্ধশতকের দিন বল হাতে ৩৯ রানে দুই উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ প্রথমবার ভারতের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে যে জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ দল সে ম্যাচেও ব্যাট হাতে অপরাজিত ৩১ রান করার পর বল হাতে ৩৬ রান দিয়ে ২ উইকেট শিকার করেন তিনি। ১৩ আগস্ট ২০০৬, নাইরোবির জিমখানায় বল হাতে ৫৩ রানে ৩ উইকেট নেয়ার পর ৪৩ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে দলকে ২ উইকেটের জিতিয়েছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৬ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বগুড়ায় ব্যাট হাতে অপরাজিত ২৩ এবং বল হাতে ৩৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। ব্যাট হাতে দারুণ কিছু করার ক্ষমতা রাখেন সেটার প্রমাণ আগেও অনেকবার দিয়েছেন। আর ঘরোয়া ক্রিকেট প্রায় নিয়মিতই দুর্দান্ত কিছু ইনিংস উপহার দিয়েছেন। এ বছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে (ডিপিএল) মাত্র ৫০ বলের একটি টর্নেডো শতক হাঁকান যা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম শতকের রেকর্ড। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেকদিন সেভাবে ভাল কোন ইনিংস খেলতে পারেননি বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। অবশেষে, একেবারে উপযুক্ত সময়েই দলের বিপদের মুহূর্তে আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস খেললেন তিনি। রবিবার মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ওয়ানডেতে খেললেন মাত্র ২৯ বলে ২ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৪ রানের ঝড়ো ইনিংস। ওয়ানডে ক্রিকেটে তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ছক্কা হাঁকানোর অর্ধশতকটাও করে ফেলেছেন এর মাধ্যমে। দারুণ ব্যাটিংয়ের পর বল হাতেও শুরু থেকেই আগুন ঝরান মাশরাফি, যেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামটা অনেক দিন পর আবার মনে করিয়ে দেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। ইংলিশ টপঅর্ডার তছনছ করে দেন প্রথম স্পেলেই ৩ উইকেট নিয়ে। শুরুটা করার পর শেষও করেছেন তিনিই। ইংল্যান্ডের শেষ উইকেট তুলে নিয়ে ৮.৪ ওভারে ২৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে দিনটা নিজের করে নেন। কতদিন পর ম্যাচসেরা হলেন মাশরাফি? ২০১৪ সালের নবেম্বরের পর। ২০১৪ সালের অক্টোবরে আবার নেতৃত্ব ফিরে পান। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথমবার দলের অধিনায়ক হলেও এক ম্যাচ খেলেই ইনজুরির কারণে ছিটকে গিয়েছিলেন। ৫ বছর পর আবার নেতৃত্ব পেয়ে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৩ উইকেট নিয়ে। খোলা চোখে দেখলে, অনেকটা সময় আর বেশ কিছু ম্যাচে সেরা হতে পারেননি তিনি। কিন্তু অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশের সেরা পেসার এবং দ্বিতীয় সেরা বোলার মাশরাফিই। এই সময়টায় সাকিব আল হাসানের (৪৪) পর সবচেয়ে বেশি উইকেট মাশরাফিরই (৪০)! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২৯ রানে ৪ উইকেট পেয়েছেন মাশরাফি। ওয়ানডেতে সর্বশেষ ৪ উইকেট পেয়েছিলেন ঠিক ৮ বছর আগে আরেকটি ৯ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এত বছর পর ৪ উইকেট! একটু বিশদ খুঁজলে দেখা যাবে, এই ৮ বছরে যথারীতি বাংলাদেশের সেরা পেসার এবং দ্বিতীয় সেরা বোলার মাশরাফিই। এই সময়টায় সাকিবের (১৬৪) পরই সবচেয়ে বেশি উইকেট মাশরাফির (রাজ্জাকের সঙ্গে যৌথভাবে, ৯৮ উইকেট)। চোট জর্জর ক্যারিয়ারে গতি কমে অনেক সীমাবদ্ধতা চেপে বসলেও কিভাবে দিনের পর দিন শিকার ধরার নতুন অস্ত্র বের করেছেন মাশরাফি। ব্যাটে-বলে মাশরাফি হতে পারতেন দেশের অন্যতম এক অলরাউন্ডার, পারেননি এই ইনজুরির শত্রুতার কারণে। বর্তমানে ওয়ানডের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবই বলেছেন, ‘তিনি হতে পারতেন অন্যতম একজন অলরাউন্ডার। হয়তো হাজার দেড়েক রান করেছেন মাশরাফি ভাই, কিন্তু এই রান করেই বাংলাদেশকে কত ম্যাচ জিতিয়েছেন! আমরা তিন/চার হাজার রান করেও সেটা পারিনি।’ সর্বোচ্চ অপরাজিত ৫১ ছাড়াও অপরাজিত ৪৪ রান করেছিলেন কেনিয়ার বিরুদ্ধে ১৭ মার্চ ২০০৬ সালে বগুড়ায়। এছাড়া নাইরোবিতে ১৩ আগস্ট ২০০৬ কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ৪৩ ও ১২ মার্চ ২০০৭ ভারতের বিরুদ্ধে মিরপুরে ৪২ রান- এ কয়েকটিই তার ওয়ানডেতে চল্লিশোর্ধ ইনিংস। আর টেস্টে তিনি তিনটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন যার মধ্যে ৭৯ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংসও আছে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বাধিক উইকেটের মালিক মাশরাফি। ১৬৩ ম্যাচে ২৯.৭৫ গড়ে নিয়েছেন ২১৩ উইকেট। সাকিব ১৬২ ম্যাচে ২৭.৭৩ গড়ে ২১৫ উইকেট নিয়ে এখন বাংলাদেশের সেরা। তবে ক্যারিয়ার থেকে প্রায় ৫টি বছর না চলে গেলে হয়ত মাশরাফির উইকেট সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়ে এমন অবস্থানে থাকত যেটা ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি পেসারদের ক্যারিয়ারেই আছে। এখনও অফুরান মাশরাফি যেভাবে নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছেন ‘গ্রেটদের’ কাতারে পৌঁছানোর যথেষ্ট সুযোগ আছেই। আর মাশরাফি ক্রিকেট থেকে আলাদা হওয়ার মানুষ না। ৮ অস্ত্রোপচার পারেনি, অন্য কিছুও পারবে না। তাই অন্যরকম এক উচ্চতায় পৌঁছুতে চলেছেন তিনি এটা একেবারেই অবধারিত।
×