ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উরি হামলার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আঘাত, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা ছাড়িয়ে কমান্ডোরা ৩ কিমি ভেতরে;###;দুই পাকসেনা ও ৪০ জঙ্গী নিহত;###;সীমান্তে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা

পাকিস্তানের জঙ্গী ঘাঁটিতে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাকিস্তানের জঙ্গী ঘাঁটিতে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’

নাজিম মাহমুদ ॥ উরি হামলার প্রতিশোধ নিতে এবার পাকিস্তানের জঙ্গী ঘাঁটিতে আঘাত হানল ভারত। বুধবার মধ্যরাতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অন্তত তিন কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়ে ভারতীয় কমান্ডোরা। ভারতীয় সেনাদের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামের এ সফল অভিযানে দুই পাক সেনা ও অন্তত ৪০ জঙ্গী নিহত হয়। ভারতীয় কমান্ডোরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত অবস্থান করে। এ সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ভীমবার, লিপা, হটস্প্রিং ও কেলসহ অন্তত সাতটি জঙ্গীঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় তারা। হামলার এ খবর পাক কর্তৃপক্ষকে ফোনে জানায় ভারত। প্রথমে অবশ্য এসব হামলার কথা উড়িয়ে দেয় পাকিস্তান। পাকিস্তান বলছে, স্রেফ বানোয়াট ও সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক অভিযান চালানো হয়েছে। এ হামলার সমুচিত জবাব দেবে ইসলামাবাদ। পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেছেন, পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় বাহিনীর এ আগ্রাসনের কঠোর নিন্দা জানায় পাকিস্তান। পাক প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় বাহিনীর এ নগ্ন আগ্রাসন ও পাক সার্বভৌমত্বের ওপর যে কোন অশুভ সিদ্ধান্ত রুখে দিতে পাক সেনাবাহিনী সক্ষম। আজ মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠক ডেকেছেন নওয়াজ। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ বলেছেন, রণাঙ্গনে পাক সেনাবাহিনী বরাবরই পারঙ্গম। বৃহস্পতিবার এ্যাবোটাবাদে পাক সেনাবাহিনীর তরুণ সেনাদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, পাক সেনাবাহিনী যে কোন উস্কানি রুখে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রতিবেশী দেশের যে কোন আগ্রাসন রুখে দিতে নৌবাহিনীকে সতর্ক রেখেছে পাকিস্তান। পাক বিমানবাহিনী জানিয়েছে, যে কোন মূল্যে তারা পাকিস্তানের আকাশপথ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখবে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হামলার আশঙ্কায় জম্মু-কাশ্মীর, গুজরাট, রাজস্থান ও পাঞ্জাব সীমান্তের সকল স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে ভারত। নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের। পাশাপাশি ওই সব এলাকায় হাইএ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। ওদিকে, পাকিস্তানের মাটিতে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ অভিযান সফলভাবে পরিচালনার জন্য ভারতীয় সেনাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দেশটির শীর্ষ নেতারা। হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইস ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ফোন করে ভারতের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন বলে একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে। তবে পাক গণমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে ফোন করে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চলমান সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। আর আলোচনার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান সমস্যার সুরাহার কথা বলেছে চীন। চীনা পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, আমরা ভারত-পাকিস্তানের এ উত্তেজনা বিষয়ে অবগত। বেজিং আলোচনার মাধ্যমে দেশ দুটির চলমান সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান আঞ্চলিক শান্তি রক্ষার জন্য কাজ করবে বলে আমরা আশাবাদী। খবর পিটিআই, এনডিটিভি, ডন, জিও নিউজ, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও এক্সপ্রেস ট্রিবিউন অনলাইনের। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দিল্লীতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘোষণা করে যে, তারা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার অন্যদিকে পাকিস্তানের ভেতরে অভিযান চালিয়েছে। এ সময় ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ ঘাঁটিতে হামলা চালানোর কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিং বলেন, কাল রাতের (বৃহস্পতিবার) ওই হামলায় সন্ত্রাসবাদীদের এবং যারা তাদের মদদ দিচ্ছিল, তাদের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। মারা গেছে অনেকে। আর এ হামলার খবর আমি নিজেই পাকিস্তান ডিজিএমওকে ফোন করে জানিয়েছি। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর ওই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কোন সাংবাদিককে প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয়নি। জেনারেল রণবীর সিং আরও বলেন, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক অভিযান ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। তবে এ ধরনের হামলা এখনই আর চালানোর কোন পরিকল্পনা ভারতের নেই। তিনি বলেন, বুধবার তারা নির্দিষ্ট তথ্য পান যে, নিয়ন্ত্রণরেখার পাকিস্তানী অংশের ভেতরে কয়েকটি জায়গায় ‘সন্ত্রাসবাদীরা’ তৈরি হয়েছে ভারতে ঢোকার জন্য। তাদের পরিকল্পনা ছিল জম্মু-কাশ্মীর আর ভারতের অন্যান্য রাজ্যে হামলা চালানো। এসব ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনাবিাহিনীর অভিযান চালানোর কথা জানিয়ে ভারতের এ ডিজিএমও বলেন, আমরা উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে পেরেছি। এ ঘটনার পর যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরিও আছি আমরা। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল এনএন ভোরা ও মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিকেও অভিযানের বিষয়টি ভারতীয় সেনাবাহিনী অভিহিত করেছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে ভারতের বিরোধী দল ও কূটনীতিকদের বিস্তারিত জানানো হয়। বৈঠকে সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে সবাই সম্মত হয়। ওদিকে, প্রতিবেশী দেশের যে কোন আগ্রাসন রুখে দিতে পাক নৌবাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পাক নৌবাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, যে কোন ধরনের হামলা মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত। পাক বিমানবাহিনী বলেছে, বহিঃশত্রুর যে কোন হামলা রুখে দিতে আমরা তৎপর। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নাসির জানজুয়া বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেলে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক অভিযানের নানা দিক প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিফ করেন। নাসির জানজুয়া নওয়াজকে বলেন, পাক সেনাবাহিনী আমাদের ভূখ- রক্ষার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। এ সময় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নওয়াজ। ওদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামলেছেন, পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ এভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য রাখেন না বলে সমালোচনা করেছেন তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খান। এ সময় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে চার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’র হামলায় ১৮ সেনা নিহত হওয়ার পর থেকে প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা চলছে। ভারতের দাবি, পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীরা এ হামলা চালিয়েছে। ওই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোদি হামলার যোগ্য জবাব দেয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে বলতে চাই, এ হামলার পেছনে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।’ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কী? নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে সার্জিক্যাল এ্যাটাক করেছে ভারতীয় সেনা। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গীদের মোট ছয়টি ক্যাম্পে এ হামলা চালানো হয়। ভীমবার, হটস্প্রিং, কেল, লিপা- এ অঞ্চলের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সেনা পরিভাষায় এ সার্জিক্যাল এ্যাটাক কী? এককথায় একেবারে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানা। পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি যতটা সম্ভব কম রেখে টার্গেট হাসিল করাই হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সবার আত্মরক্ষার অধিকার আছে আর সে অধিকার থেকেই হামলা। এটাই হলো সার্জিক্যাল এ্যাটাক। টুইটারে ভারতীয় সেনাদের অভিনন্দন নরেন্দ্র মোদি : তে কাপুরুষোচিত হামলার পর আমরা তীব্র নিন্দা করেছিলাম। দেশকে নিশ্চিত করেছিলাম, যারা হামলার পেছনে রয়েছে তাদের রেয়াত করা হবে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর : সফল অভিযান চালানোর জন্য ভারতীয় সেনাকে অভিনন্দন। পন্ডুচেরির রাজ্যপাল কিরণ বেদী : প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাল হলে দেশে প্রাণ সঞ্চার হয়। সেনার মূল্যবান জীবনদান কখনও বৃথা যায় না বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ : পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গীঘাঁটিতে সার্জিক্যাল অপারেশন চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতীয় সেনাকে অভিনন্দন। চেতন ভগত : দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন তার ছাতির মাপের প্রতি সুবিচার করলেন। এটাই ভারত। কেউ যেন আমাদের সঙ্গে বেয়াদবী না করে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল : মাতা কী জয়। সারাদেশ সেনার পাশে রয়েছে।
×